জর্জ হ্যারিসনের 'বাংলাদেশ বাংলাদেশ'

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাঙালিকে নয়, সারা বিশ্বের সৃজনশীল মানুষকে টেনেছিল। এরকমই কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কথা—
জর্জ হ্যারিসন
জর্জ হ্যারিসন

বিটলস গায়কদের অন্যতম এবং ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। আর সেই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া শেষ গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ শতবার শোনার পরও এখনো আমাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সব স্মৃতি। আর চোখে পানি চলে আসে বারবার। এ জন্যই জর্জ হ্যারিসন এত বেশি প্রিয় আমাদের কাছে।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন ঢাকায় এলে (১৫ ফেব্রুয়ারি) সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর সঙ্গে সেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে বেশ কিছুটা সময় কথা হয়েছিল। অলিভিয়ার কাছে শুনেছিলাম যে কনসার্টটি করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর গণহত্যা তাঁর অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। অলিভিয়া আমাকে বলেছিলেন, ‘জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবিশঙ্করকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিলেন তিনি। অন্যদিকে জর্জ নিজের রেকর্ডিং নিয়েও ব্যস্ত ছিল। সত্তরে বিটলস ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে জীবন গড়তে সে মনোযোগী ছিল। সেই সময়েই রবিশঙ্কর বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চান। এই উদ্যোগে জর্জকে পাশে পেতে চান তিনি। জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার নিযুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া দেবে।’
তারপর থেকেই জর্জ কনসার্টের জন্য বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল ও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বব ডিলান আর এরিক ক্ল্যাপটন অনুষ্ঠানের এক দিন আগে নিউইয়র্কে এসে উপস্থিত হন। আর ‘ইমাজিন’ গানের অমর শিল্পী জন লেনন অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে তাঁর অপারগতার কথা জানান জর্জকে।

জর্জ হ্যারিসন কীভাবে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন, এ বিষয়ে বেশ বিস্তারিত বলেছেন তাঁর নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আই মি মাইন-এ। তিনি ১৯৭১ সালের জুন মাসে তাঁর রাগা অ্যালবামের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে কাজ করেছিলেন। সে সময় রবিশঙ্কর বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য একটা কনসার্ট করতে চান বলে জর্জকে জানান। তারপর রবিশঙ্কর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত নানা দেশের পত্রিকা ও সাময়িকীর সংবাদগুলো পাঠান জর্জের কাছে। জর্জ লিখেছেন, ‘বিষয়টি কী, আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম। আমার মনে হলো, কাজটার ব্যাপারে আমার বোধ হয় তাকে সাহায্য করা উচিত।’ তিনি লিখেছেন, ‘এভাবেই জড়িয়ে গেলাম। পরে যা “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” হয়ে ওঠে।’ তাঁর কথা, ‘সামান্য মহড়াই আমরা করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, সবার উপস্থিতিতে একটা মহড়া আমরা করতে পারিনি। নানা অসুবিধার মধ্যে অগোছালোভাবে কাজটা করলাম আমরা।...তারপর কনসার্ট করলাম আমরা। দুটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। প্রথম অনুষ্ঠানের সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় কনসার্টটি করেছিলাম। কপালই বলতে হবে, সবকিছু ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয়েছিল।’

আমরা জানি, জর্জ হ্যারিসন ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে (১৯৬৫) রবিশঙ্করের কাছে সেতারবাদন শিখতে শুরু করেন। একই সঙ্গে যোগসাধনা করেছেন। ভারতে এসেছেন কয়েকবার। তিনি ভারতীয় দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে এসে জর্জ বুঝতে পারেন যে তাঁর পক্ষে ভালো সেতারবাদক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁদের মধ্যকার গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব শেষ জীবন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এ জর্জ হ্যারিসন গেয়ে শোনান তাঁর নতুন গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’  l ছবি: সংগৃহীত
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এ জর্জ হ্যারিসন গেয়ে শোনান তাঁর নতুন গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ l ছবি: সংগৃহীত

আসলে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য করতে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এ ধরনের বড় একটি অনুষ্ঠান বিশ্বে প্রথমবারের মতো হয়েছিল। এতে জর্জ হ্যারিসন তৃপ্ত হয়েছিলেন। রবিশঙ্কর আনন্দিত হয়েছিলেন। আফ্রিকার ক্ষুধার্তদের জন্য বা অন্য কোনো বিষয়ে তারপর বিশ্বের নানা দেশে নানা বিষয়ে বড় বড় কনসার্ট হয়েছে। বিশ্বের নামীদামি শিল্পীরা তাতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান সময় পর্যন্ত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর যে ব্যাপক প্রভাব, সেটা অন্য কোনোটির ক্ষেত্রে হয়নি। আই মি মাইন বইয়ে জর্জ হ্যারিসন লিখেছেন, ‘মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু সংবাদপত্রে শুধু কয়েক লাইন, “ও, হ্যাঁ, এখনো এটা চলছে।” আমরা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। এখনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় এমন সব ওয়েটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যাঁরা বলেন, “ওহ্, মিস্টার হ্যারিসন, আমরা যখন জঙ্গলে লড়াই করছিলাম, তখন বাইরে কেউ আমাদের কথা ভাবছে, এটা জানাটাও আমাদের জন্য ছিল অনেক কিছু।’’
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান (প্রথম লং প্লেতে পাঁচটি গান আছে, তবে ২০০৫ সালের ডিভিডিতে আছে চারটি গান)। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। গানটি লিখেছেন জর্জ হ্যারিসন এবং সুরও তাঁর। গানের মূল কথাই ছিল বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। গানের কথায় এমন আবেদন ছিল যে ‘সকলের কাছে মিনতি জানাই আজ আমি তাই/ কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই’ বা ‘এত যে বেদনা রাখি দূরে/ দেবে না তোমার ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি/ মানুষগুলোকে সহায়তা দাও।’ জর্জ হ্যারিসন পুরো গানটা গেয়েছেন উচ্চ স্বরে করুণ বিলাপের সুরে গভীর মানবিক আবেদন নিয়ে। সে জন্য গানের সেই সুর আজও আমাদের উজ্জীবিত করে।
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর পর দেশে দেশে মানবতার কল্যাণে কত বড় বড় কনসার্ট হয়েছে দুনিয়াভর। কিন্তু সেসবেরই পথিকৃৎ হয়ে আছে ৪৫ বছর আগের ওই আসর। ২০০৫ সালে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অ্যালবামের ডিভিডি। দুটি ডিভিডির একটি সুদৃশ্য সেট এখনো পাওয়া যায়। একটি সিডিতে রয়েছে পুরো গানের অনুষ্ঠান। আরেকটি সিডিতে রয়েছে শিল্পী-কলাকুশলীদের সাক্ষাৎকার, যাতে কনসার্টটি আয়োজনের নেপথ্য কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। আরও আছে মহড়ার কিছু চিত্র ও গান। এর সঙ্গে আছে একটি সচিত্র পুস্তিকা। এই ডিভিডি বিক্রির অর্থ যাচ্ছে জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফে। এই নতুন ডিভিডির ভূমিকায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেছেন, ৭৫ বছরের সংগীতজীবনে যত কনসার্ট করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই কনসার্টটিই।
২০০৫ সালে পুনঃপ্রচারিত দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ডিভিডি উপলক্ষে সঙ্গে প্রকাশিত পুস্তিকায় ইউএসএ ফান্ড ফর ইউনিসেফের সভাপতি চার্লস জে. লিওনসের লেখা থেকে জানা যায়, কনসার্টের টিকিট বিক্রি থেকে সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ ডলার। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তিনটি রেকর্ডসহ অ্যালবাম এবং ১৯৭২ সালের মার্চের কনসার্ট নিয়ে তৈরি ফিল্ম থেকে আয় নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। পরবর্তী দশকগুলোতে এসব অর্থ দান করা হয় ইউনিসেফ পরিচালিত শিশুদের কল্যাণমূলক তহবিলে।

এসব কারণেই রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং ওই কনসার্টের শিল্পীদের প্রতি আমাদের আগ্রহ ও আকর্ষণ ম্লান হয় না কিছুতেই, কোনো সময়েই নয়। বরং তা প্রেরণার অফুরান উৎস হয়ে আছে। আমরা যতবার দেখি আর শুনি, সেই প্রথম দেখার মতো আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি বারবার।

অলিভিয়া হ্যারিসন জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন দিনের জন্য ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখতেই এসেছিলেন ঢাকায়। তিনি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দরিদ্র শিশু ও কিশোরদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ দেখেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য কিছু কর্মসূচি চলে জর্জ হ্যারিসন ফান্ডের সহায়তায়। সিলেটের হাওর ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশু-কিশোরদের নৌকাস্কুল কর্মসূচির জন্য সহায়তা নিয়ে অলিভিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছিল ইউনিসেফের। এটাই ছিল তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। বছরের পর বছর ধরে তিনি তাঁর প্রয়াত স্বামীর শুরু করা মানবিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন, যে কাজের সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের শিশুরাও। এভাবেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আজও সক্রিয় বাংলাদেশে।

জর্জ হ্যারিসনের গান

বন্ধু আমার এল একদিন

চোখভরা তার ধু ধু হাহাকার

বলল কেবল সহায়তা চাই

বাঁচাতে হবে যে দেশটাকে তার

বেদনা যদি বা না-ও থাকে তবু

জানি আমি, কিছু করতেই হবে

সকলের কাছে মিনতি জানাই আজ আমি তাই

কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই

বাংলাদেশ, বাংলাদেশ

দেখছি সেখানে সকলই ধ্বস্ত

কত শত প্রাণ মরে নিঃশেষ

দেখিনি এমন বেদনা অশেষ

তোমরা সবাই দুহাত বাড়াও আর বুঝে নাও

মানুষগুলোকে সহায়তা দাও

বাংলাদেশ, বাংলাদেশ

দেখিনি কখনো এত দুর্যোগ

দেখছি সেখানে সকলই ধ্বস্ত

দেখিনি কখনো এত দুর্ভোগ

দোহাই তোমরা ফিরিও না মুখ, বলো এই কথা

মানুষগুলোকে দেব সহায়তা

বাংলাদেশ, বাংলাদেশ

মনে হবে সে তো কোন সীমানায়, আমরা কোথায়

কী করে বা একে ছুড়ে দিই ফেলে

এত যে বেদনা রাখি দূরে ঠেলে

দেবে না তোমরা ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি

মানুষগুলোকে সহায়তা দাও

অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ