যুদ্ধদিনের দলিল 'মুক্তির গান'

>
মুক্তির গান চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য: একাত্তরে সাংস্কৃতিক দলের কর্মীরা সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন শরণার্থী শিবির আর মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে গান করেন l ছবি: সংগৃহীত
মুক্তির গান চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য: একাত্তরে সাংস্কৃতিক দলের কর্মীরা সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন শরণার্থী শিবির আর মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে গান করেন l ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাঙালিকে নয়, সারা বিশ্বের সৃজনশীল মানুষকে টেনেছিল। এ রকমই কিছু সাংস্কৃতিক সৃষ্টির কথা

একাত্তরে রণাঙ্গনে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছে, তখন ভিন্ন রকম আরেক যুদ্ধে নেমেছিলেন একদল তরুণ সংস্কৃতিকর্মী। তাঁদের একমাত্র অস্ত্র ছিল গান। একটি ট্রাকে করে শরণার্থীশিবির থেকে শরণার্থীশিবিরে ছুটে বেরিয়ে তাঁরা শুধু গান গেয়ে লড়াই-সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছেন মানুষকে।

সংস্কৃতিকর্মীদের এসব কর্মকাণ্ডের কাহিনি ফুটে উঠেছে এক মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্রে, যার নাম মুক্তির গান। এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল যুদ্ধের শেষ মাসগুলোয়। তবে সেটা পরিপূর্ণতা পেয়ে চলচ্চিত্রের আকার পেতে সময় লেগেছে ২৪ বছর। এই প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হওয়ার কাহিনিও আরেক চমকপ্রদ গল্প।
ছবির মূল দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় ধরেছিলেন তরুণ মার্কিন বিজ্ঞাপন নির্মাতা লিয়ার লেভিন। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি ভারতে আসেন।
যুদ্ধের দিনগুলোয় সংস্কৃতিকর্মী সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে গঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নানা রকম কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত ছিল। তাঁদেরই একটি গানের দল বিভিন্ন শরণার্থীশিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে ট্রাকে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়ে শোনায়।
লিয়ার লেভিন যখন ঠিক করেন তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানাবেন, তা-ও নিজ খরচে, তখন এই গানের দলটিকেই বিষয় করবেন বলে ঠিক করে তিনি। দলের একজন সদস্য শাহীন সামাদ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, শিল্পী সংস্থার অনুমতি নিয়ে লিয়ার লেভিন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন। ছয় সপ্তাহ ধরে তিনি শুটিং করেছিলেন। ওই একই ট্রাকে ক্রু নিয়ে তিনি উঠে পড়েছিলেন।
কিন্তু আমেরিকান নাগরিক হওয়ায় লিয়ারকে মুখোমুখি হতে হয় সীমাহীন প্রতিকূলতার। যুক্তরাষ্ট্র তখন যুদ্ধে বাংলাদেশের বিপক্ষে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। তাই তরুণ ওই খেয়ালি মার্কিন নির্মাতাকে নিয়ে নানা রকম সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। ভারতীয় প্রশাসনের অনেকের সন্দেহ জাগে, লেভিন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর চর হতে পারেন। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে লিয়ার লেভিন ভারত ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁর ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের বিজয়মুহূর্তের সাক্ষী হবেন। সেই ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। পরে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার লিয়ার লেভিনকে দেয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।
লিয়ার লেভিন যে প্রামাণ্যচিত্র বানাতে চেয়েছিলেন, সেটার নাম তিনি ঠিক করেন ‘জয় বাংলা’। নির্মাণের কাজও শুরু করেছিলেন। নয় মাস ধরে সম্পাদনার পর প্রায় ৭২ মিনিটের ছবিটি যখন পরিবেশকদের দেখানোর জন্য প্রস্তুত করেন, তত দিনে এর সংবাদমূল্য শেষ। যুদ্ধ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। মার্কিন দর্শকদের জন্যও ছবিটির কোনো আবেদন আর বাকি নেই। এরই মধ্যে হয়ে গেছে অনেক ধারদেনা। তাই লেভিন আবার ফিরে যান বিজ্ঞাপন নির্মাণের পেশায়। কিন্তু সযত্নে ফুটেজগুলো তিনি রেখে দেন তাঁর বাড়ির বেসমেন্টে।
এরপর ১৮ বছর পার হয়ে যায়। ১৯৯০ সালের শেষের দিকের কথা। নির্মাতা তারেক মাসুদ ক্যাথরিন শেপিয়ারকে বিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কপ্রবাসী। বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘স্ট্র্যান্ড’-এ কাজ করছেন। ক্যাথরিন যোগ দিয়েছেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার নির্বাহী হিসেবে। একদিন তাঁদের দেখা হয় জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর (বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্যসচিব) সঙ্গে। তিনি ছিলেন তারেকের চাচাতো ভাই মাহমুদুর রহমান বেণুর বন্ধু। বেণু ছিলেন একাত্তরের সেই শিল্পী দলের নেতা, লেভিনের প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়বস্তু যে দল। ওই দলে আরও ছিলেন বিপুল ভট্টাচার্য, দেবব্রত চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী, শারমিন মুর্শিদ, নায়লা খান, লুবনা মারিয়াম, লতা চৌধুরী ও দুলাল চন্দ্র শীল।
তারিক আলী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিয়ার লেভিনের প্রসঙ্গ তোলেন। তাঁর কথা শুনে তারেক ও ক্যাথরিন প্রচণ্ড আগ্রহী হন। কিন্তু দুই দশক আগের সেই খেয়ালি মার্কিন যুবক এখন কোথায়, কারও জানা নেই। মাসুদ দম্পতি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে তাঁরা খুঁজে বের করেন লিয়ারের টেলিফোন নম্বর। যোগাযোগ করেন। তারেকের ফোন পেয়ে লিয়ার চমকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, এত বছর ধরে হয়তো তিনি এই ফোনটির জন্যই অপেক্ষা করছেন।
তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ ঠিক করেন, লিয়ার লেভিন যেখানে থেমে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আবার শুরু করবেন তাঁরা। স্বাচ্ছন্দ্যে ফুটেজগুলো ব্যবহার করতে অনুমতি দেন লেভিন। নির্মাতারা ঠিক করেন, প্রায় ১৮ ঘণ্টার এই ফুটেজের সঙ্গে তাঁরা যোগ করবেন মুক্তিযুদ্ধের আরও ঐতিহাসিক ফুটেজ। এমন একটি চলচ্চিত্র তাঁরা নির্মাণ করতে চাইলেন, যেটি দেখে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী হবে। ছবিটি এমনভাবে সম্পাদিত হবে, যেন এটিকে তথ্যচিত্র মনে না হয়।
লিয়ার লেভিনের ফুটেজে গানগুলো ছিল অসম্পূর্ণ। মুক্তির গান নির্মাতারা সেই সব শিল্পীকে দিয়েই ১১টি গান রেকর্ড করালেন। ছবিতে ব্যবহৃত কয়েকটি গান ছিল ‘পাক পশুদের মারতে হবে’, ‘এই না বাংলাদেশের গান’, ‘কিষান মজুর বাংলার সাথি রে’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘বলো রে বাঙালির জয়’, ‘যশোর খুলনা বগুড়া পাবনা’, ‘বাংলা মা-র দুর্নিবার আমরা তরুণ দল’। এ ছাড়া ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘দেশে দেশে ভ্রমি’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানগুলো। ছিল নজরুলের গানের সুর ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায়’।
ওই শিল্পী দলের সদস্য তারিক আলী বলেন, ‘১৯৭৩ সালে লিয়ার লেভিনের স্টুডিওতে ফুটেজগুলো প্রথম দেখেছিলাম। পরে সেসব দৃশ্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মুক্তির গান-এ। যে বেদনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের উদ্ভব, তারেক ও ক্যাথরিন সেটাকে ধরতে পেরেছিল।’