আটটি শিশুর দায়িত্ব কে নেবে?

১২ ডিসেম্বর যখন আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়, খোরশেদ আলম (৩৭) তখন বজরা বাজারে চটপটি বিক্রি শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী জোটের তৃতীয় দফা অবরোধের সেটা পঞ্চম দিন।

খোরশেদের বাড়ির পথে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আফানিয়া বাজারের কাছাকাছি গাছ ফেলে রাস্তা অবরোধ করা হয়েছিল। অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কয়েকটি গুলি ছোড়েন। একটি গুলি এসে খোরশেদের পেটে বিঁধে। পরদিন ভোরে জেলা হাসপাতালে তিনি মারা যান।

সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নের উত্তর রসুলপুর গ্রামে খোরশেদের ছোট্ট ঘর। জোড়াতালির বেড়া, টিনের চালে ফুটো। ১৮ ডিসেম্বর এই প্রতিবেদক সেখানে গেলে সদ্যবিধবা জহুরা খাতুনের (২৭) বিলাপ থামতে চায় না, ‘আঁর স্বামী তো বাল-বাচ্চার লাই রুজি কইত্ত গেছে, কোনো সময় আড্ডা দিতও যায় ন, মিছিল-মিটিংয়েও যায় ন। হেতেনেরে কিল্লাই গুলি মারা অইল? কি খাই বাঁইচপো এই আষ্টোগ্গা হোলাহাইন (আটটি ছেলেমেয়ে)?’

খোরশেদ চটপটি বিক্রি করে রোজ যা রোজগার করতেন, তাতেই কোনোমতে স্বামী-স্ত্রী আর আট সন্তানের বড় সংসারটা চলত। ছয় মেয়ে ও দুই ছেলের সবার বড় রুনা আক্তারের বয়স ১৩ বছর। সবার ছোট মারিয়ার বয়স সাত মাস। বড় ছেলে পারভেজ (৯) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে।

গ্রামে ঢুকে খোরশেদের বাড়ির খোঁজ করলে একজন প্রতিবেশী প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি কিস্তির লোক?’ ব্যবসার জন্য খোরশেদ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৩৫ হাজার এবং আশা থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। পরিবারটি এখন কিস্তি আদায়কারীদের আগমনের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে।

জহুরা বলেন, সপ্তাহান্তে কিস্তির এক হাজার ২০০ টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ব্যবসা আর সংসারের বাইরে দেশ-দুনিয়া নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসত ছিল না তাঁর স্বামীর। কাদের মোল্লার ফাঁসির কথা শুনেছেন জহুরা, তবে নির্বাচনের ব্যাপারে কিছুই জানেন না: ‘নির্বাচন দিইয়া আমাগো কি অইব? আমরা এক্কানা শান্তিতে ঘরে ঘুমাইতাম চাই। আর দুই মুঠ ভাত খাই বাঁইচতাম চাই।’

ঘরের ভেতরে কেঁদে চলে দুধের শিশু মারিয়া। চার দিন ধরে জ্বরে কাতরাচ্ছে সে। মায়ের হাতে ওষুধটুকু কেনার টাকা নেই। প্রতিবেশী মো. বাবুল বলেন, তাঁরা এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে চাল-ডাল তুলে কয়েক দিনের খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, কিন্তু এগুলো ফুরালে কী হবে?