রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়

তাঁদের কেউ রাজনীতি করতেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে মিছিল-সমাবেশে স্লোগান দেননি। নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা নিয়ে রাজপথে গলা ফাটাননি। কিন্তু তাঁদেরও রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হতে হয়েছে।
গত ২৫ নভেম্বর একতরফা সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত শনিবার পর্যন্ত বিরোধী জোটের অবরোধ-আন্দোলনকালে সহিংসতায় অন্তত ৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন, যাঁদের রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংস্রব নেই।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট এই ২৮ দিনে পাঁচ দফায় অবরোধ পালন করছে। ১০ ডিসেম্বর থেকে যোগ হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে ছড়ানো উত্তেজনা।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বলছে, এই ৪৬ জনের অধিকাংশই মারা গেছেন ১০ ডিসেম্বরের আগে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এসব হত্যা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। তাঁদের প্রায় অর্ধেকই খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ। জীবিকার তাগিদে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তাঁরা। ফিরেছেন লাশ হয়ে। পরিস্থিতির শিকার হয়েছে শিশুরাও।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলী মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ১২ বছরের সুমন সরকার ৯ ডিসেম্বর চুল কাটিয়ে বাড়ি ফিরছিল। বাজারে তখন পুলিশকে ঘিরে ধরে ককটেল ও ইটপাটকেল ছুড়ছিলেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়লে দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সুমন।

১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সুমনের বাবা আনোয়ার হোসেন আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘হাসিনা-খালেদা গদি নিয়ে টানাটানি করব, আর আমাগো মতো গরিব মাইনষের ছাওয়াল গুলি খাইয়া মরব।’ রাজনীতি মোটেই টানে না মা আছরুনকে। তাঁর আক্ষেপ, ‘পোলাডা সকালে ভাত না খাইয়া চুল কাটাইতে গেছিল। কইছিল, আইসা ভাত খাইয়া কাজে যাইব। কিন্তু ভাত আর ছাওয়ালডার পেটো গেল না।’

অভাব-অনটনের জন্য চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া চালাতে পেরেছিল সুমন। এ বছরই ১০০ টাকা রোজে একটি চিপস তৈরির কারখানায় কাজ নেয় সে। দিনমজুর বাবা আর তার রোজগারে খেয়ে না-খেয়ে চলত ছয়জনের সংসার।
সুমন নিহত হওয়ার পর কেউ কি পরিবারটির কাছে এসেছিল? বাবা বলেন, ‘গ্রামের মেম্বার আসছিল।’ আর কেউ খোঁজ নেয়নি। কেউ কোনো সাহায্যের আশ্বাসও দেননি।

অবরোধকালে যানবাহনে ককটেল বা পেট্রলবোমা ছুড়ে বা আগুন ধরিয়ে দেওয়ার কারণে মারা গেছেন অন্তত ১৪ জন। ২৮ নভেম্বর ঢাকার শাহবাগে একটি বাসে লাগানো আগুনে পোড়া ১৯ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত চারজন মারা গেছেন। ঘুমন্ত পরিবহনশ্রমিককে ভেতরে রেখে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিক। ১০ ডিসেম্বর গাজীপুর সদর উপজেলায় মোগরখাল এলাকায় রাতে একটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলে পুড়ে মারা যান এক মা ও মেয়ে।

রাজমিস্ত্রি, ছাত্র, পোশাকশ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোটখাটো চাকরিজীবী—অনেকে মারা গেছেন সংঘাত-সহিংসতার ডামাডোলে দুর্ঘটনা অথবা ধাওয়ার মধ্যে পড়ে। পরিবহনচালক বা চালকের সহকারীরা আগুনে পুড়ে নিহত হয়েছেন, দুর্ঘটনাও তাঁদের মেরেছে।

নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। প্রথম অবরোধের প্রথম দিনেই রাজধানীর বাসায় ফেরার পথে খিলগাঁওয়ের গোড়ানে ককটেল হামলায় মস্তিষ্ক বিস্ফোরিত হয়ে যায় মধ্যবয়সী আনোয়ারা বেগমের। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে পরদিন তিনি মারা যান। দুই ছেলে ও এক মেয়ের সংসারে বিধবা এই নারীই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম।

তেমনই আরেকজন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিলাম ইউনিয়নের তেলিপাড়া গ্রামের সোয়েব আহমেদ। ৫ ডিসেম্বর দক্ষিণ সুরমায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের হরতালের মধ্যে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন সোয়েব। পাঁচটি মোটরসাইকেলে চেপে পিকেটাররা এসে মোটরসাইকেলের তালা দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করলে তিনি চলন্ত অটোরিকশা থেকে ছিটকে পড়েন। পরদিন ভোরে হাসপাতালে তিনি মারা যান। তিন ভাই ও দুই বোনের পরিবারে সোয়েব ছিলেন একমাত্র রোজগেরে।

সোয়েবের উপার্জনে তাঁর ছোট তিন ভাইবোনের লেখাপড়া চলত, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পড়াশোনার খরচও মিটত। সোয়েবের মা সুমিনূর বেগম বলেন, ‘হাসিনা যেলা (যেভাবে) তান বাপর (বাবা) হত্যার বিছার করছইন, আমার পুয়া (ছেলে) হত্যার বিচার ওলা করতে ওইব। আমার পুয়ারে যেলা তারা মারছে, ইলা (এভাবে) কোনো মানষে মানষরে মারে না। আমি সরকাররে দাবি জানাই বিছার করার।’
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সাহায্য করেছেন শরিফুল হাসান, ঢাকা এবং উজ্জ্বল মেহেদী, সিলেট]