সুন্দরবনে আরও আটটি টাওয়ার স্থাপনের আবদার টেলিটকের

.
.

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় এবার আটটি টাওয়ার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকারি খাতের মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক। আগামী মার্চের মধ্যে ওই টাওয়ারগুলো স্থাপন করতে চায় সংস্থাটি। এই আবদার জানিয়ে সংস্থাটি ইতিমধ্যে বন বিভাগকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে।
টাওয়ার স্থাপনের পর তা পরিচালনার জন্য টেলিটক সুন্দরবনের ভেতরে তেলচালিত জেনারেটরও স্থাপন করতে চেয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে টেলিটক সুন্দরবনের কটকা, মোংলাসহ তিনটি এলাকায় টাওয়ার স্থাপন করে। এবার যে আটটি এলাকায় তা করতে চাইছে, সেগুলো ওই তিন এলাকার চেয়েও পরিবেশগতভাবে বেশি সংবেদনশীল ও সমৃদ্ধ। জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের বিচরণ এলাকা।
অবশ্য টেলিটক একাধিকবার চিঠি দিলেও বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর এখনো টাওয়ার স্থাপনের অনুমতি দেয়নি। স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর টাওয়ারের তরঙ্গের প্রভাব কী, সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে নতুন কোনো টাওয়ার স্থাপন করা যাবে না—উচ্চ আদালতের এই নির্দেশ উল্লেখ করে বন বিভাগ এ ব্যাপারে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ চেয়েছে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বন্য প্রাণী অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী অধ্যাপক রেজা খান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের প্রতিবেশব্যবস্থা হাজার বছর ধরে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে। এখানে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপই এর ক্ষতি করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল ফোনের টাওয়ারের কারণে পাখি ও কীটপতঙ্গের ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুন্দরবনে তিন বছর আগে যখন তিনটি টাওয়ার স্থাপন করা হয়, তখনই উচিত ছিল পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা। আর সুন্দরবনের ভেতরে তাদের কেন টাওয়ার স্থাপন করতে হবে, তা-ও আমি বুঝতে পারছি না। বিশ্বে বড় বনগুলোতে এ ধরনের টাওয়ার স্থাপনের কোনো নজির দেখিনি।’
রেজা খান বলেন, অন্তত আগের টাওয়ারগুলো স্থাপনের পর হলেও এর প্রভাব বোঝার জন্য সমীক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু সংস্থাটি তা না করে আবারও আটটি টাওয়ার স্থাপনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সুন্দরবনের জন্য অনেক অজানা ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

টেলিটক সুন্দরবনের সাতক্ষীরা জেলাধীন দুবেকি, কাবিখালি, পুষ্পকাঠি, নটাবেকী, মান্দারবাড়ীয়া; বাগেরহাট জেলাধীন চর দুয়ানী, কোকিল মণি ও কচিখালী এলাকায় এসব টাওয়ার স্থাপনের অনুমতি চেয়েছে। যুক্তি হিসেবে টেলিটক বলছে, বনদস্যু দমন, বন বিভাগের কর্মীদের মধ্যে সহজে যোগাযোগ স্থাপন, গহিন বনে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক স্থাপনই এর উদ্দেশ্য। তবে রেজা খান বলেছেন, এ ধরনের জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনে বনদস্যু দমন ও যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ওয়্যারলেস যন্ত্রই যথেষ্ট। বন বিভাগের কর্মীদের তা আছে। তাই এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না।

গত ৮ ডিসেম্বর টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ প্রধান বন সংরক্ষককে দেওয়া চিঠিতে বলেছেন, আগামী মার্চের মধ্যে সুন্দরবনের ওই আট এলাকায় মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপনের কাজ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অন্যথায় বর্ষা মৌসুমে বিরূপ ও প্রতিকূল পরিবেশে কোনোভাবেই কাজ করা যাবে না। টেলিটকের টাওয়ার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করছেন গিয়াস উদ্দিন। বর্তমানে তিনি দেশে না থাকায় এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

তবে প্রকল্পটির উপপরিচালক রেজাউল কবির প্রথম আলোকে বলেন, মার্চের আগেই তাঁরা সব ধরনের সমীক্ষা ও অনুমতি নিয়েই টাওয়ার স্থাপন করবেন।

পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বিদ্যমান পরিবেশ ও বন আইনের আলোকেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তবে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনাকেও আমরা এ ক্ষেত্রে আমলে নেব।’

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জীববৈচিত্র্যের সবচেয়ে বড় আধার সুন্দরবনে এমন স্থাপনা সব ধরনের বন্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। ফলে কোনোভাবেই তাঁরা সুন্দরবনের ভেতর এই টাওয়ার স্থাপন করার অনুমতি না দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল বাসার বলেন, ‘সুন্দরবনের বেশির ভাগ বৃক্ষের পরাগায়ন ঘটে মৌমাছির মাধ্যমে। মোবাইল ফোনের টাওয়ারের তরঙ্গ ও বিকিরণ মৌমাছির জীবনচক্রকে লন্ডভন্ড করে দেবে। এভাবে একে একে সুন্দরবনের চারপাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পকারখানা এবং সর্বশেষ মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপন করলে এই বনটাকে আমরা আর মনে হয় রক্ষা করতে পারব না।’

যে আটটি স্থানে টেলিটক টাওয়ার স্থাপন করতে চাইছে, সেগুলো বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের জন্য সংরক্ষিত। এসব এলাকায় সব ধরনের অবকাঠামো নিষিদ্ধ তো বটেই, সেখানে যে কারও প্রবেশাধিকার পর্যন্ত নিষিদ্ধ। সুন্দরবনের ওই সব এলাকা বাঘ, হরিণ, পাখি, ডলফিন ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সংবিধানে জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণীর অধিকার এই সরকারের আমলেই যুক্ত হয়েছে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনও বর্তমান সরকারের আমলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সংবিধান ও আইনে বন্য প্রাণীর জন্য সব ধরনের ক্ষতিকর তৎপরতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। সরকার যেখানে অন্যদের ওই আইন ও সংবিধানের ধারা মেনে চলার জন্য কাজ করবে, সেখানে সরকারি সংস্থাগুলো বন্য প্রাণীর সবচেয়ে বড় আধার সুন্দরবন ধ্বংসের তৎপরতা চালাচ্ছে।

আইনে যা আছে: পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী মোবাইল ফোনের টাওয়ারের মতো বড় স্থাপনা লাল ক্যাটাগরির। এমন স্থাপনা করার আগে প্রাথমিক পরিবেশগত পরীক্ষা (আইইই) করে প্রাথমিকভাবে অবস্থানগত ছাড়পত্র নিতে হবে। তারপর প্রকল্পের পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা প্রতিবেদন (ইএমপি) করতে হবে। এরপর পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদন (ইআইএ) করতে হবে। এসব জমা দেওয়ার পর পরিবেশ অধিদপ্তর তা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পর্যালোচনা করে অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়। এই অনুমোদন পেলেই প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করা যায়।

কিন্তু টেলিটক এখনো এই তিনটির একটির প্রতিবেদনই করেনি। ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে স্বরাষ্ট্রসচিব) সব মন্ত্রণালয়ের কাছে লিখিতভাবে ওই তিনটি সমীক্ষা প্রতিবেদন করার পর যেকোনো প্রকল্পের কাজ শুরুর জন্য বলেছিলেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শাহজাহান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাছে এখনো এই বিষয়টি আসেনি।’ ফলে এ নিয়ে মন্তব্য করতে তিনি অপারগতা জানান।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, মোবাইল ফোনের টাওয়ারের তরঙ্গ ও বিকিরণ সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তারপর টাওয়ার করতে দেওয়া হবে কি হবে না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তবে সাধারণভাবে এটি পরিষ্কার, টাওয়ার পরিচালনার জন্য যে জেনারেটর চালানো হবে, তার শব্দ ও দূষণ অবশ্যই সুন্দরবনের জন্য বেশ ক্ষতিকর হবে।