পুলিশ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

রাজারবাগে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন l প্রথম আলো
রাজারবাগে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন l প্রথম আলো

‘বেইজ ফর অল স্টেশন্স, ভেরি ইমপোর্টেন্ট মেসেজ। প্লিজ কিপ নোট। বেইজ ফর অল স্টেশনস অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ। কিপ লিসেন, ওয়াচ। উই আর অলরেডি অ্যাটাক্ট বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ। ওভার অ্যান্ড আউট।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগে অবস্থিত তৎকালীন পুলিশের কেন্দ্রীয় ওয়ারলেস বেজ স্টেশন থেকে এই বার্তাটি দেশের বিভিন্ন পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয়েছিল। বেতার অপারেটর শাহজাহান মিয়া রাত সাড়ে ১১টার দিকে ‘হেলিকপ্টার ব্যাজ’ মডেলের একটি বেতারযন্ত্র থেকে এই বার্তাটি পাঠান। ঐতিহাসিক এই যন্ত্রটি এখন স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
ওই দিনই পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইনস আক্রমণের ঠিক আগে তৎকালীন আইজিপির বডিগার্ড আবদুল আলী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করতে পাগলা ঘণ্টা বাজান। আওয়াজ শুনে পুলিশ সদস্যরা সালামি গার্ডের (পাগলা ঘণ্টা) পাশে জড়ো হন। তাঁরা অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে অবস্থান নেন। ওই পাগলা ঘণ্টাও রয়েছে জাদুঘরটিতে। আজ সোমবার পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী দিনে জাদুঘরটির নতুন ভবন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের টেলিকম ভবনে প্রথম জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। আর এখনকার ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই। জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ ও ইউনিফর্ম রাখা হয়েছে। দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত পুলিশের বিভিন্ন অস্ত্র ও সরঞ্জাম স্থান পেয়েছে এখানে।
গতকাল রোববার জাদুঘর ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শেষ সময়ের ধোয়ামোছা চলছে। জাদুঘরের সঙ্গে জড়িত সব পুলিশ কর্মকর্তা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। জাদুঘরে ঢুকলে প্রথমেই পড়বে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। ভেতরে ঢুকলেই দুপাশের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ২০টি বাণী একের পর এক দেখতে পাবে দর্শনার্থীরা। ডান পাশে রয়েছে একটি ভার্চ্যুয়াল লাইব্রেরি। আর বাঁ পাশে রয়েছে একটি অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষ।
পুলিশ সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার বলেন, লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নয় শতাধিক বই রয়েছে। এ ছাড়া লাইব্রেরিতে প্রাথমিকভাবে ছয়টি কম্পিউটার থাকবে, যেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে যত বই বা লেখা রয়েছে, সেগুলো পড়া যাবে। আর অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষে বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর সালের মধ্যে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনা যাবে।
বঙ্গবন্ধু গ্যালারির ঠিক মাঝখানে একটি গোলাকার জায়গা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে জাদঘুরের মূল কক্ষে। সেখানে দেখা মিলবে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র ও অস্ত্রপাতি। রয়েছে ভাওয়াল রাজা কর্তৃক তৎকালীন পুলিশপ্রধানকে উপহার দেওয়া ঘোড়ার গাড়ি এবং ১৮৬৩ সালে পুলিশের ব্যবহৃত ‘লেটার বক্স’।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আবিদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, পুরো জায়গাটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে একজন দর্শনার্থী মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান জানার পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর ইতিহাসও জানতে পারবে।
দেড় বিঘা জমির ওপর এই নতুন জাদুঘর সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শুক্রবার খোলা থাকবে বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। বুধবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকবে। ১০ টাকা টিকিটের বিনিময়ে সর্বসাধারণের জন্য জাদুঘর উন্মুক্ত থাকবে।
জাদুঘর ভবনের নকশা করেছেন স্থপতি মীর আল-আমিন। তিনি বলেন, স্মৃতিসম্ভটির আদলেই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনের উচ্চতা যাতে স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতার বেশি না হয়, সে কারণে ভূগর্ভে করা হয়েছে জাদুঘরের মূল। জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোক্তা পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে পুলিশের অবদান অনেক। এ অবদান ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আগেই জাদুঘর করার প্রয়োজন ছিল। তিনি বলেন, পৃথিবীতে শুধু বাংলাদেশ পুলিশেরই নিজেদের স্বাধীনতাযুদ্ধের জাদুঘর রয়েছে।