অভিযোগহীন নিঝুম দ্বীপ

নিঝুম দ্বীপে পরিদর্শক দুলাল মিয়া ও উপপরিদর্শক মো. ইয়াছিন। ছবি: প্রথম আলো
নিঝুম দ্বীপে পরিদর্শক দুলাল মিয়া ও উপপরিদর্শক মো. ইয়াছিন। ছবি: প্রথম আলো

দ্বীপের নাম নিঝুম দ্বীপ। হাতিয়া উপজেলার এ দ্বীপটি কিন্তু মোটেও নিঝুম নয়। প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বাস এ দ্বীপে। আর এ নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নে একটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র আছে। তবে সেখানে অভিযোগ নেই বললেই চলে।

কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জানালেন, দিন, সপ্তাহ, মাসের হিসাবে নয়, বলতে হবে বছরে কয়টা অভিযোগ পাওয়া গেল। পুলিশ সদস্যদের মতে, নিঝুম দ্বীপে মানুষের সরব উপস্থিতি থাকলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ শান্ত। হাতিয়া থানা সূত্রও জানিয়েছে, এমনও হয় যে দু-তিন মাসেও এ ইউনিয়ন থেকে একটি অভিযোগও আসে না।
নিঝুম দ্বীপের ২ নম্বর ওয়ার্ডে একটি সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্রেই চলছে এ তদন্ত কেন্দ্র। বর্তমানে এখানে দায়িত্ব পালন করছেন ১৭ জন পুলিশ সদস্য। নিঝুম দ্বীপে বেড়াতে আসা সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে দিতেই চলে যায় দিনের বড় একটি অংশ।
১৮ জানুয়ারি গণমাধ্যমকর্মীদের ২০ জনের একটি প্রতিনিধিদল পল্লী-কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় নিঝুম দ্বীপে পরিচালিত বিভিন্ন কার্যক্রম দেখতে যান। নিঝুম দ্বীপের ঘাট থেকে শুরু করে আবার ঘাটে ট্রলারে তুলে দেওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য প্রতিনিধিদলের সঙ্গে থেকে দায়িত্ব পালন করেন। কাজের ফাঁকে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের।
দ্বীপটিতে তিনটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তবে এলাকাবাসী জানালেন, শিক্ষক থাকেন না বলে স্কুলের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। বিদ্যুৎ নেই বলে ঘরে ঘরে টেলিভিশনের দৌরাত্ম্য নেই, তবে মুঠোফোনের উপস্থিতি ভালোই আছে। একটি মোবাইল টাওয়ার বসেছে ইউনিয়নে। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের চালে সোলারও বসানো হয়েছে।
পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ পরিদর্শক দুলাল মিয়া এখানে দায়িত্ব পালন করছেন এক মাস হলো। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখানে শুধু জনগণের নিরাপত্তা দিচ্ছি, অভিযোগ তেমন একটা আসে না। এলাকাটিকে বেশ শান্তই বলা যায়।’ কোনো ঘটনা ঘটলে জনগণ হাতিয়া থানায় মামলা করে। কোনো পুলিশ সদস্য ওই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেলে তা এলাকায় তদন্ত করেন।
দুলাল মিয়ার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই জানুয়ারি মাসে তাঁদের কাছে দুটি অভিযোগ আসে। এর একটি অপহরণ মামলা অন্যটি বন বিভাগের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ। এর বাইরে আর কোনো তদন্তাধীন মামলা নেই।
তবে দুলাল মিয়া জানালেন, ইউনিয়নে সরকারদলীয় দুটি গ্রুপের মধ্যে কোন্দল আছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় কিছু সংঘাতের ঘটনা ঘটে, তার কিছু রেশ থেকে গেছে। এলাকায় যৌতুক, নারী নির্যাতনসহ কোনো অভিযোগ আসেনি এক মাসের মধ্যে।
আশ্রয়কেন্দ্রের চারটি কক্ষের মধ্যে পুলিশ সদস্যরা থাকেন। সম্প্রতি এতে শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তদন্ত কেন্দ্রের ১৭ জন পুলিশ সদস্যের জন্য আছে একটি মাত্র মোটরসাইকেল। কোনো ঘটনা ঘটলে পায়ে হেঁটে এবং রাস্তায় কোনো মোটরসাইকেল পাওয়া গেলে তাই নিয়ে ছুটতে হয় সদস্যদের। তাঁরা যে রেশন পাচ্ছেন, তা দ্বীপে আনা সম্ভব হয় না। স্থানীয় বাজারে যা পাওয়া যায়, তা-ই খান সদস্যরা। স্থানীয় একজন ছেলে রান্নার কাজটি করে দিচ্ছেন।
এ তদন্ত কেন্দ্রে পুলিশ সদস্যরা সাধারণত ছয় মাসের জন্য এখানে দায়িত্ব পালন করেন। আড়াই মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছেন এএসআই মো. ইয়াছিন। তিনি এলাকার পানি সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, লবণাক্ততার জন্য শিশুরা ডায়রিয়ায় মারা যায়। অন্যান্য অসুখ তো আছেই। তিনি কথার সঙ্গে যোগ করলেন, ‘এলাকার সবাইরে ভালো রাখছে আল্লায়, জরুরি কিছু হইলে খবর ছিল।’
উপপরিদর্শক কাজী আলাউদ্দীন তদন্ত কেন্দ্রে পাঁচ মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানালেন, এলাকায় জমিসংক্রান্ত বা পারিবারিক পর্যায়ে কিছু ঘটনা ঘটে। তবে এলাকায় হত্যা, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে না। এসব ঘটনা অভিযোগ আকারে আসে না। এলাকার জনগণ পর্যটকদের ক্ষতি করে না। কেননা পর্যটক যত বেশি আসে, তাদের আয়ের পথ তত বাড়ে।
কাজী আলাউদ্দীন পুলিশ সদস্যদের যাতায়াত ও যানবাহন সমস্যার কথা উল্লেখ করে বললেন, তবে এ কথাও ঠিক, অভিযোগের পর তাৎক্ষণিকভাবে সহায়তা করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। মোটরসাইকেলে একজন চালকসহ খুব বেশি হলে দুজন যাওয়া সম্ভব হয়। একজন পুলিশ সদস্য বললেন, ‘এখানে একবার এলে আর যাওয়ার উপায় নেই। আর এলাকায় পুলিশ ছাড়া সরকারের আর কোনো কর্মীর স্থায়ীভাবে দেখাও মেলে না।’
এলাকার জনগণও জানালেন, এলাকায় সন্ত্রাসের ঘটনা অনেক কমই ঘটে। ভাড়ায় মোটরসাইকেলের পাশাপাশি দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে। চালক খোকন মিয়া হাসতে হাসতেই বললেন, ‘নাহ, এইখানে অশান্তি তেমন একটা হয় না, শান্তি আছে।’
হাতিয়া থেকে এসে ১৯৯২ সাল থেকে দ্বীপে বাস করছেন সেলিনা আক্তার। তিনি এবং তাঁর স্বামী নিঝুম দ্বীপ বিদ্যানিকেতন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেলিনা আক্তার বললেন, ‘না না, আমরা কোনো অভিযোগ নিয়া কেন্দ্রে যাই নাই, যাওয়া লাগে নাই।’
একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জানালেন, ২০১৩ সাল থেকে তাঁরা এ দ্বীপে কাজ করছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মী হয়রানির শিকার হয়েছে, সে ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম ফারুকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ দ্বীপের নিরুপদ্রব বৈশিষ্ট্যের একটি পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বললেন, ‘তিন থেকে চার মাসেও নিঝুম দ্বীপ থেকে একটি অভিযোগও আসে না। উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ে এখানে অপরাধের সংখ্যা অনেক কম।’
পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক দুলাল মিয়া বললেন, ‘ইউনিয়নে পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র আছে বলেই হয়তো অপরাধের ঘটনা কম ঘটছে। পুলিশ না থাকলে অবস্থা কেমন হবে তা কে জানে। আর বন বা জলদস্যুরা একেবারে নেই, তা বলার উপায় নেই। তাই সব সময় নজর রাখতে হয় যাতে বাইরে থেকে কোনো সন্ত্রাসী এলাকায় ঢুকতে না পারে।’ যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি স্পিডবোট বরাদ্দ দিলে কাজ করা অনেক সহজ হবে বলে উল্লেখ করলেন।

পুলিশ সদস্যদের কাছে একটি খুশির খবর, তাঁদের জন্য নতুন একটি ভবন তৈরি হচ্ছে। এর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। এখানে থাকার কষ্টটা অন্তত কমবে।