পাবনায় দেশের ২৭তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার

.
.

পাবনার মোবারকপুরে নতুন একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে বাপেক্স। সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্যের ভূ-কাঠামোয় (স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচার) এই ক্ষেত্রের অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। এটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত দেশের ২৭তম গ্যাসক্ষেত্র। এই ক্ষেত্র থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্যাস উত্তোলনের জন্য আরেকটি কূপ খননের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
বাপেক্সের সূত্র জানায়, ক্ষেত্রটিতে খনন করা অনুসন্ধান কূপ থেকে কয়েক দিন ধরে গ্যাস উঠেছে। কূপের ওপরে স্থাপিত পাইপ দিয়ে গ্যাসের উদ্গিরণ শুরু হলে তাতে আগুন দিয়ে অগ্নিশিখা প্রজ্বালন করা হয়, যা কোনো ক্ষেত্রে গ্যাসের অবস্থানের প্রমাণ। তবে ওই গ্যাস উঠেছে কখনো উচ্চ চাপে, কখনো চাপ ছিল কম।
সেখানে কর্তব্যরত ব্যক্তিদের কয়েকজন প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিশিখা নিভিয়ে গত রোববার থেকে কূপটিতে নানা ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। ফলাফল থেকে ক্ষেত্রটির আকার নির্ধারণ, সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ নির্ণয় প্রভৃতি কাজে তথ্য পাওয়া যাবে, যার ভিত্তিতে পরবর্তী কূপটি খনন করা হবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নওশাদ ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মোবারকপুর ক্ষেত্রে গ্যাসের অবস্থান সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। তবে সেখানকার জটিল ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর কারণে বিদ্যমান কূপটি খননে অনেক জটিলতা ও দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ হওয়ায় গ্যাসের প্রবাহ বিঘ্নিত হয়েছে। হয়তো কূপের গভীরে কোনো সমস্যা হওয়ায় এমনটি হয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, বাপেক্স মনে করছে, মোবারকপুরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তোলার মতো গ্যাস পাওয়া যাবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, মোবারকপুর ক্ষেত্রে গ্যাসের অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে গ্যাস আছে। তবে বিদ্যমান কূপটির মাধ্যমে সেই গ্যাস বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য বলে প্রমাণ করা যায়নি। তবে অন্য কূপ খনন করে তা করা যাবে। কারণ, কূপটি খনন করে অনেক বড় একটি স্তরসহ দুটি গ্যাসের স্তর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এর আগে দেশে মোবারকপুরের মতো ভূ-কাঠামোয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে শুধু ভোলার শাহবাজপুরে। এই দুটি ক্ষেত্রই দেশের বেঙ্গল বেসিনভুক্ত এলাকায়। দেশের অন্য সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে সুরমা বেসিনে, অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভূ-কাঠামোয়, যার ভূতাত্ত্বিক নাম ‘অ্যান্টি ক্লেইন স্ট্রাকচার’। এই কাঠামোর সব ক্ষেত্রই সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে। মোবারকপুর গ্যাসক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হচ্ছে, যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এই প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেল। ভূ-বিজ্ঞানীদের অভিমত হচ্ছে, মোবারকপুরের ভূ-কাঠামোয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার দেশের মধ্যে বেঙ্গল বেসিনে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিল। এর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের আরও অনেক স্থানে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেসব স্থানেও এখন অনুসন্ধান চালাতে হবে।
তাত্ত্বিক ভূতত্ত্ব অনুযায়ী স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচারে (মোবারকপুরের মতো ভূ-কাঠামোয়) তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু প্রকৃতি যে কখনো কখনো এই তত্ত্ব নাকচ করে দেয়, সে নজিরও আছে। ভারতের ওএনজিসি মোবারকপুর ভূ-কাঠামোর ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একই ধরনের ভূ-কাঠামোয় তেল পেয়েছে। ওই কাঠামোর ইছাপুর নামক স্থানে খনন করা কূপটির কাছাকাছি ওএনজিসি ইতিমধ্যে দ্বিতীয় একটি কূপও খনন করেছে বলে জানা গেছে।
উত্তরাঞ্চলে তেল-গ্যাস আবিষ্কারের চেষ্টা কমই হয়েছে। ১৯৯৪ সালে বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় একটি অনুসন্ধান কূপসহ ওই অঞ্চলে ষাটের দশকের পর থেকে মোবারকপুরের আগ পর্যন্ত মাত্র তিনটি কূপ খনন করা হয়। তবে সেগুলোতে তেল-গ্যাস পাওয়া যায়নি। তার আগে-পরে ওই অঞ্চলে একাধিক দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালানো হয়েছে। কিন্তু কোনো অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়নি।
মোবারকপুর অঞ্চলে প্রথম দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালায় পেট্রোবাংলা, ১৯৮০-৮১ সালে। এরপর জার্মান প্রতিষ্ঠান প্রাকলা সাইসমো ১৯৮৩-৮৪ সালে সেখানে জরিপ চালায়। ওই দুটি জরিপেই সেখানে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানা যায়। এরপর ২০০৬-০৭ ও ২০০৭-০৮ সালে বাপেক্স আবার সেখানে দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করে। এই সব কটি ভূকম্পন জরিপেই সেখানে ভূগর্ভের ৪ হাজার ২৫০ মিটার থেকে ৪ হাজার ৭০০ মিটারের মধ্যে গ্যাসের পাঁচটি স্তর চিহ্নিত করা হয়েছিল।