ভোগান্তির নাম 'সিটিং সার্ভিস'

.
.

ঢাকার ‘লোকাল’ নামে পরিচিত বাসগুলো রং বদলিয়ে হয়ে যাচ্ছে ‘গেটলক সিটিং’ বাস। এতে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা সংকটে পড়ছেন। এসব বাসে সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার নিয়মও মানা হচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন পথে লোকাল এবং গেটলক সিটিং নামে দুই ধরনের বাসসেবা চালু আছে। মহানগর পরিবহন নীতিমালায় লোকাল বা সিটিং ভেদে কোনো হেরফের নেই।
লোকাল বাস বলতে যেসব বাস দাঁড়ানো যাত্রী নেয়, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করায়, এমন বাসকে বোঝায়। এর ভাড়া তুলনামূলক কম। আর গেটলক সিটিং বাস নির্দিষ্ট আসন পূর্ণ হয়ে গেলে আর যাত্রী নেয় না, নির্ধারিত গন্তব্যের আগে থামে না বা পথিমধ্যে যত্রতত্র যাত্রী তোলে না। গেটলক সিটিং বাসেরও আবার রয়েছে রকমফের। কোনো পরিবহনের নামের নিচে ‘কম স্টপেজ’ আবার কোনোটির নিচে ‘কাউন্টার সার্ভিস’ লেখা।
নিয়মিত গণপরিবহন ব্যবহার করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা লাবিবা আক্তার। তিনি বলেন, প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার সময় ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে হয়। আগে যেসব বাস হাত তুললে দাঁড়াত, এখন সিটিংয়ে রূপান্তরের কারণে সেগুলোও আর দাঁড়ায় না। বিকেলে বাসায় ফেরার সময়ের কষ্টটা আরও অসহ্য।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গণপরিবহন–ব্যবস্থায় সিটিং সার্ভিস নামে আলাদা কোনো সেবার কথা বলা নেই। তবু যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়ার জন্য নানান নামে ব্যবসা করছেন পরিবহনমালিকেরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ঢাকা মহানগরে অভ্যন্তরীণ রুটে নিয়মিত চলাচল করে প্রায় ছয় হাজার বাস। ঢাকা মহানগরে বিআরটিএ–নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া বাসের জন্য ৭ টাকা আর মিনিবাসের জন্য ৫ টাকা। অথচ গেটলক সিটিং সার্ভিসের বাসগুলোতে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ৫০ টাকা পর্যন্ত নিতে দেখা যায়।

প্রতিটি বাসে বিআরটিএ–নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা টাঙানোর নিয়ম আছে। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন পথে চলাচলকারী অন্তত ২০টি পরিবহনের বাসে উঠে দেখা যায়, নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা টাঙানো নেই। আর গেটলক সিটিং সেবা বলা হলেও দাঁড়ানো যাত্রী নিতে এবং যেখানে–সেখানে থামিয়ে যাত্রী নামাতে দেখা গেছে অন্তত ১১টি পরিবহনের বাসকে।

রাজধানীর আজিমপুর থেকে গাজীপুরের চৌরাস্তা পর্যন্ত ‘ভিআইপি-২৭’ নামের একটি বাসসেবা চালু আছে। কোম্পানিটির বাসসেবা চালু আছে ‘কাউন্টার সার্ভিস’ নামে। এই বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫০ টাকা। অর্থাৎ কোনো যাত্রী যদি আজিমপুর থেকে উত্তরা যেতে চান, তাঁকে ৫০ টাকার টিকিট কাটতে হবে। আবার কেউ আজিমপুর থেকে ফার্মগেট যেতে চাইলে তাঁকেও ৫০ টাকার টিকিট কাটতে হবে; যদিও গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ভাড়া ৭০ টাকা।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে নিয়মিত বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি যাতায়াত করেন আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি যেতে ১৫ টাকা লাগে। অথচ ভিআইপি-২৭ নম্বরে গেলে ৫০ টাকা খরচ করতে হয়। এর তো কোনো মানে হয় না।’ অন্য বাস পাওয়ার জন্য অনেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সময়মতো পাওয়াও যায় না বলেও তিনি জানান।

ঢাকার গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া থেকে গাজীপুরের আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত চলাচল করে ‘এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিবহন লিমিটেড’ বা ‘৩ নম্বর’ বাস। এই বাসে উঠে স্বল্প দূরত্বে গেলেও ভাড়া ১০ টাকা। তারা সম্প্রতি ‘স্পেশাল সার্ভিস’ নামে নতুন কিছু বাস চালু করেছে, যেগুলোতে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ভাড়া ৫০ টাকা। পরিবহনটির মালিকপক্ষের লোকজন বলছেন, নতুন বাসে সেবার মান ভালো, তাই ভাড়া একটু বেশি। তবে যাত্রীরা অভিযোগ করেন, এ পরিবহনের অধিকাংশ বাসেই যাতায়াত করা কষ্টকর। ৩ নম্বর বাসের নিয়মিত যাত্রী আবুল হোসেন বলেন, ‘পরিবহন–সংকটের কারণে এই বাসে করে নিয়মিত অফিস করতে হয়। পুরোনো বাসগুলো সবই আনফিট। ফলে অনেক বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

এ ছাড়া আজিমপুর থেকে মিরপুর ইসিবি চত্বর চলাচলকারী মিরপুর লিংক বাসটির সর্বনিম্ন ভাড়া ২৬ টাকা। বিহঙ্গ পরিবহন লিমিটেড যাতায়াত করে মিরপুর রূপনগর থেকে আজিমপুর পর্যন্ত। এই পরিবহনের সর্বনিম্ন ভাড়া ১৬ টাকা। ফাল্গুন পরিবহন উত্তরার হাউস বিল্ডিং থেকে আজিমপুর পর্যন্ত চলাচল করে। তারা সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করে ১৮ টাকা। এই রুটে নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া সাত টাকা।

মিরপুর থেকে গুলিস্তান ও মতিঝিল চলাচলকারী ল্যামস পরিবহন, হাজি ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড, খাজাবাবা পরিবহন লিমিটেড, ইটিসি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড ও বিকল্প অটো সার্ভিস লিমিটেডের বাসগুলোর সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। এ ছাড়া মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে কমলাপুর, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এবং মোহাম্মদপুর থেকে সায়েদাবাদ চলাচলকারী আয়াত পরিবহন, হিমাচল পরিবহন, নবকলি পরিবহন, মেশকাত ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড ও এভারেস্ট পরিবহন লিমিটেডেরও সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। ঢাকার অন্যান্য রুটে চলাচলকারী লাব্বাইক ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড, ওয়েলকাম ট্রান্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড, স্বাধীন এক্সপ্রেস, ঠিকানা এক্সপ্রেস লিমিটেড ও স্বাধীন পরিবহনের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ থেকে ১৫ টাকা। উল্লিখিত রুটগুলোর সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা।

নিউ ভিশন, বসুমতী ট্রান্সপোর্ট, ট্রাস্ট বাস সার্ভিসসহ আরও কয়েকটি পরিবহনের ‘সিটিং সার্ভিস’ বা ‘কম স্টপেজ’ সর্বনিম্ন ভাড়ার সীমা মানছে না। এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে গুলশান-বনানীতে ‘ঢাকা চাকা’ নামের বিশেষ বাসসেবা চালু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, যেগুলোর সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা।

মিরপুরের দুয়ারীপাড়া থেকে আজিমপুর পর্যন্ত ‘আশীর্বাদ পরিবহন’–এর সিটিং সার্ভিস মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১৬ টাকা। এই পরিবহনের বাসগুলো পুরোনো। অন্তত তিনটি বাসের কয়েকটি জানালায় কাচ নেই এবং পেছনের অংশ ভাঙা দেখা গেছে।

দেখা গেছে গেটলক সিটিং সার্ভিস বাসগুলোর নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর রয়েছেন পরিদর্শক বা ‘চেকার’। দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে কি না এবং মোট কতজন যাত্রী বাসে রয়েছেন, সেটি লিখে তিনি স্বাক্ষর করেন। পরিদর্শক ওঠার আগে নেমে গেলে স্বল্প দূরত্বের জন্য ন্যূনতম ভাড়া দেওয়া যায়। কিন্তু যে যাত্রী পরিদর্শক ওঠার পর কোথাও নামেন, তাঁকে পুরো পথের ভাড়াটাই দিতে হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলছেন, মহানগরে পরিবহন সেবায় অনিয়ম বন্ধের জন্য তাঁদের চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কমবেশি প্রতিদিনই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। অনিয়ম বন্ধ করতেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বাসমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, এর আগে একবার ভ্রাম্যমাণ আদালত ভিআইপি-২৭ বাসের রুট পারমিট বাতিল করেছিল। কোম্পানিটি তখন বলেছিল, এসব সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু তারা তা করছে না। মহাসচিব বলছেন, বাসমালিকেরা সিটিং বাস চালু করেন যাত্রীদের চাহিদার কথা ভেবেই। তবে বেশি ভাড়া নেওয়াটা অনিয়ম।

ঢাকা মহানগর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি) কোন পথে কোন বাস চলবে, তার অনুমতি দেয়। ভাড়া নির্ধারণে তাদের ভূমিকা থাকে। মহানগর পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বাধীন এ কমিটি বাসে ভাড়ার তালিকা টাঙানোর বিষয়টিরও নজরদারি করে। আরটিসির সদস্যসচিব এবং বিআরটিএর বিভাগীয় উপপরিচালক মাসুদ আলম বলছেন, ‘সিটিং সার্ভিস বলে আলাদা কিছু নেই। যদি কোনো পরিবহন যাত্রীদের বিশেষ সেবা দিতে চায়, তারা সেটা পারবে। কিন্তু কেউ এর জন্য বেশি ভাড়া আদায় করতে পারে না।’