২৯ ডিসেম্বর দলে দলে ঢাকায় আসুন: খালেদা

খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়া

‘একতরফা’ নির্বাচন প্রতিহত করতে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা অভিমুখে অভিযাত্রা কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট। চলমান আন্দোলনকে পরবর্তী ধাপে উন্নীত করতে ঘোষিত এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বা ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’।
বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল মঙ্গলবার গুলশানে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, তাঁদের কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনী প্রহসনকে ‘না’ বলা এবং গণতন্ত্রকে ‘হ্যাঁ’ বলা।
২৯ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে যোগ দিতে সারা দেশ থেকে দল-মত, শ্রেণী-পেশা, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সক্ষম নাগরিকদের লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা হাতে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, যাঁরা ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে আছেন, যাঁরা গণতন্ত্র চান, ভোটাধিকার রক্ষা করতে চান, শান্তি চান, যাঁরা গত পাঁচ বছর নানাভাবে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, শেয়ারবাজারে ফতুর হয়েছেন, সবাই পথে নামুন।
কর্মসূচিতে বাধা না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, জনতার এই অভিযাত্রায় বাধা দেবেন না। যানবাহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ করবেন না। নির্যাতন, গ্রেপ্তার, হয়রানির অপচেষ্টা করবেন না। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা এলে জনগণ তা মোকাবিলা করবে।
খালেদা জিয়া নির্বাচন প্রতিহত এবং ‘অবৈধ’ সরকারকে অসহযোগিতা করার জন্য সরকারি সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই স্বৈরশাসনের সময় ফুরিয়ে এসেছে। কাজেই তাদের ক্রীড়নক হয়ে কেউ নিজ নিজ বাহিনীর সুনাম ও ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন করবেন না। বিএনপির আন্দোলনে সাধারণ ও নিরপরাধ মানুষের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সে জন্য নেতা-কর্মীদেরও সতর্ক করেন বিরোধীদলীয় নেতা।
খালেদা জিয়া বলেন, এই সংগ্রামে বিজয়ের পর সবাই মিলে অখণ্ড জাতীয় সত্তা গড়ে তোলা হবে। হানাহানির অন্ধকার বন্ধ করা হবে। সুশাসন কায়েম করা হবে। সমঝোতার ভিত্তিতে প্রধান জাতীয় সমস্যা ও বিরোধীয় ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা হবে।
লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া সরকারের ব্যর্থতা, কূটনৈতিক নানা ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন। বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার যৌক্তিকতা এবং নির্বাচনের নামে ‘প্রহসনের’ কথা উল্লেখ করেন। গত পাঁচ বছরে সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতাদের সম্পদের পাহাড় হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতেই প্রমাণিত হয় এই সরকার সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকার পোড়ামাটি নীতি নিয়েছে। সরকারের এই বর্বরতা হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনা চলে।
আন্দোলনে করণীয়: বিরোধীদলীয় নেতা চলমান আন্দোলনে করণীয় ও নীতি-কৌশল তুলে ধরেন। তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে সমন্বয়, সমঝোতা ও ঐক্য গড়ে তুলতে বলেন। তিনি ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটিগুলোর পাশাপাশি জেলা, উপজেলা ও শহরে ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী তামাশা প্রতিহত করা এবং সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী, সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের যুক্ত করার পাশাপাশি তাদের জানমালের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের সরকারি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখার আহ্বান জানান।
এখনো সমঝোতা সম্ভব: সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক সংকট নিরসনে দুই দলের মধ্যে যে সংলাপ চলছিল, তা সরকারের কারণে ভেস্তে গেছে। তৃতীয় দফা সংলাপের পর সরকারদলীয়দের পক্ষ থেকে আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, এখনো সমঝোতার মাধ্যমে সংকট সমাধান সম্ভব। সময় শেষ হয়নি। আলোচনায় বসুন। তিনি আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানে তাঁর দলের আন্তরিকতার কথা তুলে ধরেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘এখন যে নির্বাচন হচ্ছে, তা ইলেকশন নয়, সিলেকশন। ইতিমধ্যে ১৫৪ জন জিতে গেছে। বাকি আসনেও ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি আসলেও নাকি এমনভাবেই আসন ভাগাভাগি করা হতো। এতে নির্বাচন নিয়ে সরকারের তামাশা প্রমাণিত হয়েছে। বিরোধী দলকে পলায়নপর রেখে সরকার নির্বাচন করতে চায়।’
সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘যে পথে হাঁটছেন, তাতে পা চোরাবালিতে আটকে যেতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, একগুঁয়েমি মনোভাব বদলান।’ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন-প্রক্রিয়া যুক্তির নয়, জেদের; বাস্তবসম্মত নয়, অপকৌশলের।
বিএনপির চেয়ারপারসন গণতন্ত্রকে ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’ মন্তব্য করে বলেন, সমঝোতা স্থাপন করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিয়ে বিএনপি সমঝোতা স্থাপন করেছিল। এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। প্রহসনের নির্বাচনের তফসিল বাতিল করুন। আলোচনা শুরু করুন। বিএনপি আলোচনায় বসতে রাজি আছে।
নির্বাচন কমিশনের প্রতি পরামর্শ: খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে বলেন, ‘এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অব দ্য পিপল’ হবে না। এটা হবে, ‘বাই দ্য ইলেকশন কমিশন, ফর দ্য আওয়ামী লীগ, অব দ্য আওয়ামী লীগ’। নির্বাচনের নামে এই গণবিরোধী প্রক্রিয়া বন্ধ করার সাধ্য না থাকলে নির্বাচন কমিশনের অন্তত পদত্যাগ করা উচিত।
পাকিস্তানের ভূমিকায় বিএনপি মর্মাহত: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের সংসদে প্রস্তাব পাসের বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। তিনি দাবি করেন, এর আগে এই বিষয়ে বিএনপির অবস্থান জানানো হয়েছে। পাকিস্তানের এই আচরণে বিএনপি মর্মাহত।
খালেদা জিয়া বলেন, পাকিস্তান এখন সহস্র মাইল দূরবর্তী এক পৃথক রাষ্ট্র। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের সরকারই ত্রিদেশীয় চুক্তি সই করেছিল। সেই চুক্তিতে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার এবং অতীত তিক্ততা ভুলে সামনে অগ্রসর হওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। এরপর কোনো ইস্যু নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হলে তা কূটনৈতিকভাবেই নিরসন করা উচিত। কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে সরকার এ প্রসঙ্গকে পুঁজি করে দেশের ভেতরে নোংরা রাজনীতি করার চেষ্টা করছে।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় বাস্তবায়ন ও নির্বাচনকে একই সময়ে নিয়ে এসেছে। বিএনপিও যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের।
সশস্ত্র বাহিনী প্রসঙ্গে: বিএনপির চেয়ারপারসন অভিযোগ করেন, সরকার তালিকা করে বেছে বেছে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে। বিভিন্ন জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
শেখ হাসিনার সমালোচনা: খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা দুটি গুরুতর কথা বলেছেন। এক. সমঝোতার মাধ্যমে আসনগুলো ভাগাভাগি করেছেন তাঁরা। বিএনপি অংশ নিলেও এটা করা হতো। দুই. বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে। জনগণকে আর বিরোধী দলকে ভোট দিতে হলো না। এতে জাতি অভিশাপমুক্ত হয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কথাতেই পরিষ্কার হয়েছে, নির্বাচন নয়, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে আসন ভাগাভাগির প্রহসনই তিনি চেয়েছেন। বিরোধী দল অংশ নিলেও একই রকম প্রহসনের চেষ্টাই করতেন। প্রধানমন্ত্রী এমন ব্যবস্থা করেছেন, যাতে জনগণ বিরোধী দলকে ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ না পায়।
ড. ইউনূস প্রসঙ্গ: খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নারীর ক্ষমতায়ন ও ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে অর্জিত অগ্রগতিকে রক্ষার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। আমি এই আন্দোলনকেও জনগণের অধিকার রক্ষার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ বলেই মনে করি।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আর এ গণি, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, ১৮ দলের শরিক এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর ইজ্জতউল্লাহ, বিজেপির আন্দালিব রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।