বিপণনের সংকটে চট্টগ্রামের প্রকাশনা

.
.

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্র–জনতার মিছিলে পুলিশের গুলির ঘটনার কথা শুনে চট্টগ্রামে তাৎক্ষণিকভাবে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি লিখেছিলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসের স্বত্বাধিকারী আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার অসীম সাহসের সঙ্গে রাতারাতি সেই কবিতাটি ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। এভাবে চট্টগ্রাম থেকেই একুশের প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয়। সেটিই ক্রমশ এ দেশের ঐতিহ্যে পরিণত হয়। একুশ এলেই সংকলন ও বই প্রকাশ হয় দেশজুড়ে। এমন ঐতিহ্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু হলেও বিপণনের সংকটের কারণে চট্টগ্রামের প্রকাশনাশিল্পের প্রত্যাশিত বিকাশ ঘটেনি বলে মনে করেন এখানকার প্রকাশক ও লেখকেরা।
শিশুসাহিত্যে এ বছর বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শৈলী প্রকাশনীর কর্ণধার কবি রাশেদ রউফ তাই বলেন, ‘মুদ্রণশিল্পের বিকাশে চট্টগ্রামের অবদান থাকলেও এখানে প্রকাশনাশিল্পের বিকাশ তেমন ঘটেনি। প্রচুর সম্ভাবনা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের প্রকাশনাশিল্প এখনো ভিত্তি তৈরির সংগ্রাম করছে। অথচ অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই চট্টগ্রামে প্রকাশনার যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিপণনসংকটের কারণে চট্টগ্রামে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেভাবে বাড়ছে না বইয়ের বাজার।’
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য চট্টগ্রামের প্রকাশনাশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ চট্টগ্রামের বড় বড় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে বলে জানালেন রাশেদ রউফ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত স্কুল ও কলেজগুলোর জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার বই কেনা হয়। ক্রয়কৃত বইয়ের অর্ধেকও যদি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত বই থাকত, তবে এখানকার প্রকাশনাশিল্পের সংকট অনেকটা দূর হতো। জেলা প্রশাসনও নিতে পারে অনুরূপ ব্যবস্থা।
রাশেদ রউফের প্রকাশনা সংস্থা শৈলী থেকে এই বইমেলায় ২৫টি বই প্রকাশিত হচ্ছে। এসবের মধ্যে ড. মইনুল ইসলামের প্রবন্ধের বই বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র ও অনুন্নয়ন, কাজী রুনু বিলকিসের নির্বাচিত কলাম, রওশন আরা বিউটির সুরের আকাশে শুকতারা, নাহিদ বানুর মোগল প্রাসাদের আলোর পাখিরা, রঞ্জনা ব্যানার্জির আহেলি, শাহানা ইসলামের অরুন্ধতী, কোহিনুর আকতারের অন্তর্জালে অন্তর জ্বলে, হাসান হাফিজের ছড়ার বই এক চাঙ্গি ছড়া, রাশেদ রউফের কী ছায়া কী মায়া গো, ফারজানা রহমান শিমুর দরজা খুলে ছুট, অরুণ শীলের জনতার ছড়া, ইফতেখার মারুফের বীথি মণির গল্প, ওবায়দুল সমীরের বাবার লাল পরি উল্লেখযোগ্য।

.
.

চট্টগ্রামের প্রকাশনাশিল্পের সংকটের কথা স্বীকার করলেন চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি শাহ আলম নিপু। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের প্রকাশনার সবচেয়ে বড় সংকট হলো বিপণন। একটা বই ছাপানোর পর বিক্রির জন্য কোনো দোকান পাওয়া যায় না। বাতিঘর ছাড়া কোনো বিপণিকেন্দ্র নেই। পুরো চট্টগ্রামের মানুষ তো আর সেখানে যাবে না। আগে বইঘর, কথাকলি, ডিরোজিওর মতো বইয়ের দোকান ছিল। এখন সেগুলো নেই। কারেন্ট বুক সেন্টারে আজকাল কেউ যায় না। প্রকাশক পরিষদ চট্টগ্রামের বইয়ের বাজার বড় করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তারা চট্টগ্রামের লেখকদের বই কেনার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করছে। সিটি করপোরেশনকে বলেছেন, যেন সংস্থাটি চট্টগ্রামের প্রকাশকদের বই কেনে। গত বছর সিটি করপোরেশন বিভিন্ন স্কুলের পুরস্কার হিসেবে অনেক বই কিনেছে বলেন জানালেন শাহ আলম। তিনি চট্টগ্রামের বর্তমান প্রকাশনার সংকট মোকাবিলায় সরকারের সহায়তা কামনা করেন।
চট্টগ্রামে যে কটি প্রকাশনা সংস্থা আছে তার মধ্যে মনন, শৈলী, বলাকা, কালধারা, বাতিঘর, শব্দশিল্প, আবির, শব্দচাষ, পূর্বা, আমাদের পাঠশালা, কথন উল্লেখযোগ্য। এসবের মধ্যে এ বছর ঢাকা বইমেলায় দুটি স্টল নিয়ে বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছে বাতিঘর। বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর দাশ বলেন, চট্টগ্রাম অতীতে প্রকাশনার গৌরবোজ্জ্বল সময় পার করেছে। পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রামে সৈয়দ মোহাম্মদ শফি প্রতিষ্ঠিত বইঘরের সুনাম ছিল দুই বাংলায়। বইয়ের হরফ থেকে শুরু করে লেখক ও বিষয় নির্বাচন, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও মুদ্রণসৌকর্যে বইঘরের প্রকাশনাগুলো ছিল অতুলনীয়। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের বই প্রকাশিত হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। প্রকাশনা জগতে চট্টগ্রামের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে চায় বাতিঘর।
বাংলাদেশের সব সেক্টরের মতো প্রকাশনাশিল্পেও কিছু সংকট রয়েছে বলে দীপঙ্করের অভিমত। তিনি মনে করেন এখানকার বইয়ের বাজারটা খুব ছোট। তাই যেকোনোভাবেই পাঠকসংখ্যা বাড়াতে হবে।
বাতিঘর থেকে এবার বইমেলায় ৩০টি বই প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে দীনেশচন্দ্র সেনের সরল বাঙ্গালা সাহিত্য ও প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান, বুদ্ধদেব বসুর বই মহাভারতের কথা, শাহেদ আলীর বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান, গোলাম মুস্তফার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্চা ও অন্যান্য, এজাজ ইউসুফীর উত্তর আধুনিকতা: নতুন অন্বয়ের পরিপ্রেক্ষিত, প্রিসিলা রাজের অনুবাদে ক্লদ লেভি স্ত্রস-এর মিথ অ্যান্ড মিনিং প্রমুখ প্রবন্ধের বই উল্লেখযোগ্য। বাতিঘর এবার ছোটদের বই বের করছে আটটি। জিএইচ হাবীবের অনুবাদে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের দ্য সাইন অব ফোর, আনন্দময়ী মজুমদারের অনুবাদে ক্যারল ম্যাকক্লাউডের তুমি কি আজ বালতি ভরেছ?, ইমদাদুল হক মিলনের কিশোর গল্প, কাইজার চৌধুরীর কিশোর গল্প, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কিশোর গল্প, প্রদীপ ঘোষ নির্বাচিত-লুৎফর রহমান রিটনের আবৃত্তি উপযোগী ছড়া, রাশেদ রউফের খোলা আকাশের দিন, পিনাকী ভট্টাচার্যের ভারতীয় দর্শনের মজার পাঠ। কথাসাহিত্যের মধ্যে জিএইচ হাবীবের অনুবাদে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর, আহমেদ মুনিরের ছোটগল্পের বই শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন, বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস রাত ভ’রে বৃষ্টি, বাদল সৈয়দের অলৌকিক আঙুল উল্লেখযোগ্য। কবিতার বই বের হয়েছে তিনটি। কবি মোহাম্মদ রফিকের মানব পদাবলি, আবুল মোমেনের কাউকে টানতে হবে যতি এবং ময়ূখ চৌধুরীর পিরামিড সংসার। এ ছাড়া শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত পূর্ব বাঙলার শ্রেষ্ঠ কবিতা, শিশির দত্ত সম্পাদিত-স্বনির্বাচিত পুনঃপ্রকাশ করছে বাতিঘর। জীবনী কথা সিরিজের মধ্যে এবার বাতিঘর বের করছে আল মাহমুদের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.), মুহাম্মদ ইব্রাহীমের সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সুকান্ত ভট্টাচার্য। আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথামূলক বই বের হচ্ছে তিনটি। এগুলো হলো আবুল ফজলের রেখাচিত্র, বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক, হরিশংকর জলদাসের জলগদ্য। শহীদ কাদরীর সঙ্গে কথাবার্তা নিয়ে সাক্ষাৎকারমূলক একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রন্থমেলা ২০১৭ উপলক্ষে ‘বলাকা প্রকাশন’ থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪২টি। প্রকাশের পথে আরও ২৩টি বই। মোট গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৬৫টি। বলাকার এবারের বইগুলোর মধ্যে অনুপম সেনের সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য ভাবনা নিয়ে প্রবন্ধের বই নানা কথা নানা ভাবনা নানা অর্ঘ্য, অধিকার সংগ্রামে বহ্নিশিখা: শেখ হাসিনা এবং আত্মজীবনী জীবনের পথে প্রান্তরে। অরুণ দাশগুপ্তের গবেষণাবিষয়ক বই রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য, মহাকবি নবীন সেন , জামাল উদ্দিনের গবেষণাবিষয়ক বই চট্টগ্রামের ইতিহাস (প্রাচীনকাল) ও লোকসাহিত্যে চট্টগ্রাম, নূর মোহাম্মদ রফিকের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, আহমদ আমীন চৌধুরীর আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, চট্টগ্রামী শব্দ সম্ভার, ড. খালেদা হানুমের আত্মজীবনীমূলক বই স্মৃতির কথামালা (২য় খণ্ড), ড. মাহফুজ পারভেজের কবিতার বই মানব বংশের অলংকার, আকতার হোসাইনের কবিতার বই হাড়ের হরিণী, সত্যব্রত বড়ুয়ার রম্য রচনা ব্যাঙের সর্দি, নোমান উল্লাহ বাহারের জীবনীগ্রন্থ ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শংকর প্রসাদ দের গবেষণাবিষয়ক বই অর্থনৈতিক কূটনীতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা, দেলওয়ার হোসেনের ছন্দ শ্লোকে অনন্য চট্টগ্রাম উল্লেখযোগ্য।
ছোট কাগজ খড়িমাটি প্রকাশনায় হাত দিয়েছে পাঁচ বছর আগে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারাও। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ৬০টি বই। এবারের বইমেলায় খড়িমাটি বের করছে ২৫টি বই। এর মধ্যে মহীবুল আজিজের প্রবন্ধের বই শব্দসমর ও অন্যান্য প্রবন্ধ, সরকার মাসুদের দশকের বৃত্ত পেরিয়ে ও অন্যান্য প্রবন্ধ, হাফিজ রশিদ খানের অলস করতালি ও অন্যান্য প্রবন্ধ, দিলীপ দাশের তিতাসের অদ্বৈত, শিরীণ আখতারের উপন্যাস যুদ্ধজীবন, আকিমুন রহমানের বিকেলের নদী স্রোতে অশ্রুবিন্দুটি ভেসে এসেছিল, নিজাম সিদ্দিকীর স্মৃতিকথা সাফল্য স্মৃতি স্বপ্ন, অভীক ওসমানের নাটকের বই নাট্যচতুষ্টয়, রিজোয়ান মাহমুদের কবিতার বই দুপুরলতা, জ্যোতির্ময় নন্দীর উর্দু গল্পের অনুবাদের বই উর্দুওয়ালী উল্লেখযোগ্য।
আবির প্রকাশনীর কর্ণধার নুরুল আবসার জানালেন এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ উপলক্ষে আবির প্রকাশন থেকে ২০টি বই প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিদ্দিক আহমেদের প্রবন্ধের বই প্রভৃতি, মো. মুসলিম উদ্দিনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক বই ইতিহাসের মহানায়ক, দীপালী ভট্টাচার্যের রম্যরচনা রমণীয় রম্য, এমরান চৌধুরীর সমকালীন ছড়া, বিদ্যুৎ কুমার দাশের প্রবন্ধের বই নানা লেখা নানা খেলা, মোহাম্মদ কামাল উদ্দিনের প্রবন্ধের বই জানা অজানা কথা। এ ছাড়া কবি হাসনাত শোয়েবের ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার প্রকাশ করেছে জেব্রাক্রসিং।
চট্টগ্রামের বাইরের অনেক প্রকাশনা এবার এখানকার লেখকদের বই প্রকাশ করছে। কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস রঙ্গশালা প্রথমা প্রকাশন, ইরাবতী মাওলা ব্রাদার্স ও অর্ক অবসর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া লেখকের উপন্যাস জলপুত্র–এর ইংরেজি অনুবাদ সন্স অব দ্য সি–এর অনুবাদও বের হয়েছে অবসর থেকে। উপন্যাসটি অনুবাদ করেছেন কাজী মোস্তায়েন বিল্লাহ।
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাস দূর-সম্পর্ক প্রথমা ও ছোটগল্পের বই দুধারী তলোয়ার প্রকাশ করেছে গ্রন্থ কুটির। মহি মুহাম্মদের ছোটগল্পের বই কয়েকজন শেফালির গল্প গ্রন্থকুটির ও কিশোর গল্প জলদিঘি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
কবি প্রান্ত পলাশের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ আমার কীরাম জানি লাগে চৈতন্য, সৈয়দ সাখাওয়াতের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে বাঙ্ময় প্রকাশনী, শান্তনু চৌধুরীর উপন্যাস অন্য সময়ের প্রেম প্রকাশ করেছে পার্ল পাবলিশার্স, তাঁর উপন্যাস পর সমাচার এই যে প্রকাশ করেছে দেশ পাবলিকেশনস। ডা. প্রণব কুমার চৌধুরীর শিশুসমগ্র প্রকাশ করেছে পুঁথিনিলয়, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত শিশুরোগ নিয়ে তাঁর লেখাগুলো সংকলিত করে প্রকাশ করেছে গ্রন্থকুটির। এ ছাড়া রূপ প্রকাশন লেখকের কিশোর উপন্যাস হমুর আশ্চর্য কলম প্রকাশ করেছে। বেহুলা বাঙলা প্রকাশ করেছে ফজলুল কবিরীর ওরস মঙ্গল।