প্রমত্তা ধানসিঁড়ি নদী এখন মৃতপ্রায়

‘দুই যুগ আগেও এই নদী দিয়ে লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করত। এখন নৌকাও চলে না। সে সময় নদীও বড় ছিল। এখন তা মরা খাল হয়ে গেছে। এরপরও এখন যতটুকু আছে, সেটুকুও যদি ভালোভাবে খনন করা হতো, তাহলে নদী অন্তত বেঁচে থাকত।’
কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিবিজড়িত ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে আক্ষেপ করে এসব কথা বলছিলেন ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার ধানসিঁড়ি পারের গ্রাম হাইলাকাঠির বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব তমিজ উদ্দিন হাওলাদার।
বৃদ্ধ তমিজ উদ্দিনের কাছে ধানসিঁড়ি নদীর যৌবন এখন শুধুই অতীত। যেমন অতীত কবি জীবনানন্দ দাশের রূপ-লাবণ্যের ধানসিঁড়ি। কবি বেঁচে থাকলে হয়তো আরও ব্যথিত হতেন তাঁর স্বপ্নের ধানসিঁড়ির এই হতশ্রী দেখে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দীর্ঘ নয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীর দুই পাশ সংকুচিত হতে হতে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। এখন এর প্রস্থ কোথাও কোথাও ২৫ ফুট, আবার কোথাও তারও কম। এর তলদেশ পলি জমে প্রায় ভরাট হয়ে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পাড়ে জন্মানো আগাছা একেবারে মাঝনদীতে চলে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে ঝালকাঠির মোল্লাবাড়ি, বারৈবাড়ি এবং রাজাপুরের হাইলকাঠি, ইন্দ্রপাশা ও বাঁশতলা—এই গ্রামগুলোর বুক চিড়ে বয়ে চলা ধানসিঁড়ি নদীটি এসে রাজাপুরের জলাঙ্গী (জাঙ্গালিয়া নদী) মোহনায় মিশেছে।
এলাকাবাসী জানান, দুই যুগ আগেও এই নদী দিয়ে পাল তোলা নৌকা, লঞ্চ, কার্গো চলাচল করত। রাজাপুর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ ঝালকাঠি জেলা সদরের সঙ্গে সবচেয়ে সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক যাতায়াতের পথ ছিল এই নদী। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি কৃষিতেও বড় অবদান রাখত। সেই নদী এখন নৌকা চলাচলেরও অনুপযোগী। বর্ষা মৌসুমে নৌকা চলাচল করলেও শীত মৌসুমে তা একেবারে শুকিয়ে যায়।
শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমের বেশির ভাগ সময় নদীটি পানিশূন্য হয়ে পড়ায় দুই পাড়ের কয়েক শ হেক্টর ফসলি জমির চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। এসব জমি এখন এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। এলাকার কৃষকেরা বলেন, নদীটির নাব্য ফিরিয়ে আনতে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও যথাযথভাবে খনন না হওয়ায় তা কোনো কাজে আসেনি।
নদীর পারের বাসিন্দা রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও ছালেহা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের মাধ্যমে নদীটি খননের উদ্যোগ নিলেও নামমাত্র কাজ করানোয় ধানসিঁড়ির প্রাণ ফেরেনি।
রাজাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিয়াজ উল্লাহ বলেন, ধানসিঁড়ির দুই পারে কয়েক শ হেক্টর উর্বর জমি আছে। কিন্তু নদীটি মরে যাওয়ায় সেচের অভাবে তা এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। এসব জমিতে বর্ষা মৌসুমে আমন ধানের আবাদ করতে পারলেও শীত মৌসুমে পানি না থাকায় বোরোসহ শীতকালীন কোনো ফসলের আবাদ করতে পারছেন না কৃষকেরা।
পাউবো ঝালকাঠি কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে এই নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করার জন্য খননকাজ করানো হয়। ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তবে এলাকার লোকজনের অভিযোগ, কেবল খালের দুই পাড়ের ঝোপঝাড় পরিষ্কার এবং কিছু নরম মাটি তুলে নদীর পাড়ে রাখা ছাড়া আর কোনো কাজেই আসেনি সেই বরাদ্দ। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে অল্পদিনের মধ্যে পাড়ে তোলা সেই মাটি আবার নদীতে ফিরে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর ঝালকাঠি কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই নদীতে বিষখালী ও গাবখান দুই নদী থেকে জোয়ার প্রবাহিত হয়ে মাঝ বরাবর এসে থেমে যায়। ভাটির সময় জোয়ারে বয়ে আনা সেসব পলি আর নামতে পারে না বলে দ্রুত নদীটি নাব্য হারায়। এখন দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নদী-খাল খনন করার জন্য তালিকা করার কাজ চলছে। এই নদীও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এরপর এসব নদীর খনন প্রকল্প হাতে নেবে পাউবো।