অযত্ন-অবহেলায় ঐতিহাসিক সেই আমতলা

পুরোনো ছবি
পুরোনো ছবি

বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক গৌরবের অধ্যায়। এই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের (তখনকার কলাভবন) ঐতিহাসিক আমতলা। একুশ: ভাষা আন্দোলনের সচিত্র ইতিহাস বইটিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার আগমুহূর্তে আমতলায় ছাত্রদের সভার একটি ছবি পাওয়া গেল। জাতীয় জ্ঞানকোষ, বাংলাপিডিয়াসহ আরও অনেক সাইটেও ছবিটি রয়েছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গণপরিষদের ভাষাতালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ওই দিন ঢাকা শহরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। এ সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৫২ সালে এই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে থাকে। ১৯৫২ সালের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ করেন। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তান সরকার সেদিন ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে।

বর্তমান ছবি
বর্তমান ছবি

কিন্তু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আমতলায় জড়ো হতে শুরু করেন। তাঁরা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বিভিন্ন অনুষদের ডিন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সেখানে এসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। কিন্তু ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। ছাত্ররা ছোট ছোট দলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নামলে পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে। বিক্ষোভের একপর্যায়ে পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরকতসহ রফিক, জব্বার নিহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষুব্ধ মানুষ ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি জনতা নিহত ছাত্রদের গায়েবানা জানাজা পড়ে শোক মিছিল বের করলে পুনরায় লাঠি, গুলি ও বেয়নেট দিয়ে হামলা চালানো হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ পালনের অন্যতম কেন্দ্রভূমিও ছিল এই আমতলা। তবে ষাটের দশকে কলা অনুষদের কার্যক্রম বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হলে আমগাছটির প্রতি যত্ন কমতে শুরু করে। একসময় আমগাছটি মারা যায়। তবে আমগাছটির ওপরের অংশ তখনো ছিল। সেটি কাটার সিদ্ধান্ত হলে ১৯৯৫ সালের ২২ নভেম্বর আমগাছের মাটির ওপরের অংশটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু সংগ্রহশালাতে নেওয়া হয়। এখনো সেখানে আমগাছটি আছে। তবে ঐতিহাসিক সেই আমতলা পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়। কেউ যদি ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের গেটের সামনে ঐতিহাসিক সেই আমতলার স্থানটিতে যান, একটি সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই পাবেন না। বরং আমতলার নিচে ও আশপাশে গড়ে উঠেছে হকারদের ব্যবসা-বাণিজ্য। আর এভাবেই বিবর্ণ হচ্ছে ঐতিহাসিক আমতলা।
লেখা: শরিফুল হাসান। ছবি: অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম (পুরোনো) ও সাবিনা ইয়াসমিন (বর্তমান)