চট্টগ্রামে বর্ণময় সারা দিন

চট্টগ্রামের বর্ণমেলার মঞ্চে রাজীব বসাকের জাদু প্রদর্শন
চট্টগ্রামের বর্ণমেলার মঞ্চে রাজীব বসাকের জাদু প্রদর্শন

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে অষ্টমবারের মতো প্রথম আলো দিনভর আয়োজন করেছিল বর্ণমেলা। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে একযোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে মাতৃভাষা নিয়ে এই বর্ণাঢ্য উৎসব। আয়োজনের সহযোগী ছিল ইউনিলিভারের ব্র্যান্ড সার্ফ এক্সেল। সম্প্রচার সহযোগী চ্যানেল নাইন।

বর্ণ লিখে তা জালে আটকে দিচ্ছে এক শিশু
বর্ণ লিখে তা জালে আটকে দিচ্ছে এক শিশু

ঢাকায় সকালে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ মাঠে বর্ণমেলা উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। চট্টগ্রামে বর্ণমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। উদ্বোধন করেন অধ্যাপক মাহবুবুল হক। রাজশাহীতে বর্ণমেলার উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক।

ঢাকার আয়োজনে বর্ণদৌড়ে অংশ নেয় শিশুরা
ঢাকার আয়োজনে বর্ণদৌড়ে অংশ নেয় শিশুরা

চট্টগ্রামে

বর্ণ নিয়ে সারা বেলা মাতামাতি, ছোটাছুটি, হইহুল্লোড়। বর্ণের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা, বর্ণ লেখা, বর্ণ অঙ্কন সবই ছিল। বর্ণ নিয়ে খেলায়ও অংশ নিয়েছে শিশু-কিশোরেরা। ছিল বাহারি বর্ণ। বরাবরের মতো ফটক, মঞ্চ, মঞ্চের আচ্ছাদন ছিল বর্ণখচিত। আর মেলায় আসা অনেকের পোশাকও ছিল বর্ণময়। এমনই বর্ণময় ছিল চট্টগ্রামে আয়োজিত বর্ণমেলা।

চট্টগ্রামে ব্যান্ডদল চিরকুটের পরিবেশনা
চট্টগ্রামে ব্যান্ডদল চিরকুটের পরিবেশনা

মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার নগরের নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় মাঠে দিনব্যাপী এই মেলার আয়োজন করা হয়।

সকালে বিদ্যালয় মাঠে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর বর্ণখচিত বেলুন উড়িয়ে বর্ণমেলার উদ্বোধন করেন কুমিল্লা সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মাহবুবুল হক। সাংস্কৃতিক সংগঠন রক্তকরবীর শিল্পীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। এরপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

মেলা উদ্বোধন করে অধ্যাপক মাহবুবুল হক বলেন, ‘একুশ আমাদের জীবনে হাজার তারের বীণার মতো বাজে। একুশ আমাদের আত্মত্যাগ শিখিয়েছে। একুশের পথ ধরে পেয়েছি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সাইনবোর্ড-ব্যানারে ইংরেজি হরফের ছড়াছড়ি। ভাষা সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে পড়ছি আমরা। এই সময়ে প্রথম আলো যে বর্ণমেলার আয়োজন করেছে, সেটা জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রেরণা জোগাবে।’

অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের যেন ভাষার প্রতি, মায়ের প্রতি, বর্ণমালার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, সে জন্য প্রথম আলো বর্ণমেলার আয়োজন করে।’

বক্তব্যের পর বোধন আবৃত্তি পরিষদ ও প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের শিল্পীরা বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করেন। গান করেন অভ্যুদয় সংগীত অঙ্গনের শিল্পীরা।

চট্টগ্রামের বর্ণমেলায় চোখ বে​ঁধে স্পর্শ করে বর্ণ চেনার খেলায় মেতে ওঠে শিশুরা
চট্টগ্রামের বর্ণমেলায় চোখ বে​ঁধে স্পর্শ করে বর্ণ চেনার খেলায় মেতে ওঠে শিশুরা

প্রাপন একাডেমির বৃন্দ নৃত্য পরিবেশনার সময় ভেসে আসে একুশের কালজয়ী গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’।

জাদুর ছোঁয়ায় মঞ্চের সামনের দর্শকদের বিমোহিত করেছেন রাজীব বসাক। জাদুর পর বাউল গান পরিবেশন করেন মানস পাল। এরপর ছিল বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, সিলভার বেলস হাইস্কুল, মেরিট বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও মেরন সান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।

দুপুরের পর ছিল ব্যান্ড দল সাসটেইন পরিবেশনা। এরপর সংগীত পরিবেশন করেন অরিন, চৈতি মুৎসুদ্দী, নিশীতা বড়ুয়া, হৈমন্তী রক্ষিত, মানস পাল। সবশেষে ছিল ব্যান্ড দল চিরকুটের পরিবেশনা।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে যায় শিশু-কিশোরদের বর্ণ নিয়ে মাতামাতি। দ্বিতীয় শ্রেণির দেবলীনা মুৎসুদ্দি কালো রং দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়ে নিয়ে জমা দিয়েছে বর্ণ প্রদর্শনীতে। শিশু শ্রেণির সৌমিল শ্রীহান দত্ত আলপিন দিয়ে লিখেছে ‘আ’ বর্ণ। ভিড় ছিল এই বর্ণ প্রদর্শনীতে।

বইয়ের দোকান, অনুভবে বর্ণ ও বর্ণ পোশাক স্টলে ছিল দর্শকদের ভিড়।

রাজশাহীতে বর্ণমেলায় শিশুদের সমবেত নৃত্য পরিবেশনা
রাজশাহীতে বর্ণমেলায় শিশুদের সমবেত নৃত্য পরিবেশনা

বর্ণ অনুভবের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মাশফি। ভেতরে চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে দিয়ে একটি বর্ণ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। মাশফি বলল, ‘আমি কিন্তু চোখ বন্ধ করে বলতে পারব, কোনটা কী বর্ণ।’ ঠিকই সে পেরেছে। এ জন্য পেয়েছে পুরস্কার।

বেলুন উড়িয়ে বর্ণমেলার উদ্বোধন করেন অধ্যাপক মাহবুবুল হক
বেলুন উড়িয়ে বর্ণমেলার উদ্বোধন করেন অধ্যাপক মাহবুবুল হক

এ ছাড়া মেলায় দর্শকেরা টি-শার্ট রাঙিয়েছে নানা বর্ণে। এর জন্য আইতা, যুবরিয়া ও নিহা পুরস্কারও পেয়েছে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন স্মিতা।
প্রতিযোগিতার ফলাফল: মেলায় চিত্রাঙ্কন, হাতের লেখা ও বর্ণ প্রদর্শনী প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ক বিভাগে প্রথম হয় ফুলকি স্কুলের শারদ প্রত্যুষ বল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয় যথাক্রমে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুলের রাচিলা রহমান ও নলেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঙ্ক্তি সেন। চিত্রাঙ্কন খ বিভাগে অহনা হোসেন প্রথম, সামিয়া হোসেন চৌধুরী দ্বিতীয় ও অপূর্বা চৌধুরী তৃতীয় হয়েছে। তিনজনই বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুলের শিক্ষার্থী। চিত্রাঙ্কন গ বিভাগে সিডিএ পাবলিক স্কুলের সরওয়ার জামান তাসিন প্রথম, মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের সাজ্জাতুল ইসলাম দ্বিতীয় ও ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাজিয়া আফরিন তৃতীয় হয়।
সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতায় ক বিভাগে প্রথম হয় চিটাগং আইডিয়াল স্কুলের সাবাব ইজতেহাফ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয় যথাক্রমে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বিদ্যালয়ের রূপা দাশ ও সারমন অ্যান্ড কলেজের সাবিহা মুশফিকা। প্রতিযোগিতার খ বিভাগে প্রথম হয় লামিয়া তারান্নুম। চন্দ্রিমা চৌধুরী দ্বিতীয় ও তাহমিদা তাহরিন তৃতীয় হয়। গ বিভাগে সানজানা তাসনিম প্রথম, ফাহমিদা মনজুর দ্বিতীয় ও আদিয়াত নাওয়ার তৃতীয় হয়।
বর্ণ প্রতিযোগিতায় ক বিভাগে নওশিন বিনতে আহসান প্রথম, মনীষা কানুনগো দ্বিতীয় ও শাহানা নেওয়াজ তৃতীয় হয়। বর্ণ প্রতিযোগিতায় খ বিভাগে শ্রেয়ন্তী শ্রেষ্ঠা নন্দী প্রথম, নুসরাত জাহান দ্বিতীয় ও তাসনিম বিনতে হাসান তৃতীয় হয়। বর্ণ প্রতিযোগিতার গ বিভাগে শ্রাবন্তী সরকার প্রথম, মাহির আশহাব দ্বিতীয় ও মৃত্তিকা বিশ্বাস তৃতীয় হয়।

প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী আহমেদ নেওয়াজ, আইভী হাসান, সুব্রত দাশ, তাসলিমা আকতার, তোসাদ্দেক হোসেন, জিহান করিম। পুরস্কার তুলে দেন ফ্যাশন ডিজাইনার রওশন আরা চৌধুরী, মনিদীপা দাশ ও লুৎফা সানজিদা।

ঢাকায়

সুরের ধারার শিল্পীরা পরিবেশন করেন জাতীয় সংগীত। এরপরে গান গেয়েছেন শিল্পী ফরিদা পারভীনের গানের দল অচিন পাখির শিল্পীরা, শিল্পী অদিতি মহসিন ও প্রিয়াংকা গোপ। আবৃত্তি করেছে সানিডেল স্কুলের শিক্ষার্থী মীর ফরিয়ান মেহেবুব। পূজা সেন গুপ্ত ও তাঁর দল তুরঙ্গমীর শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশন করেছেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা গান করেছে। দলগত পরিবেশনায় আরও ছিল রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ ও ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল। আবৃত্তি করেছেন মাহমুদা আক্তার। ম্যাজিক দেখিয়েছেন আলী রাজ, পাপেট শো ছিল জল পুতুল’-এর। ছিল সিসিমপুরের পরিবেশনা। আর প্রাচ্যনাটের বিশেষ নাটক আঠারো বছর।

বিকেলের পর্বে জাদু জাদু দেখায় খুদে জাদুকর সামিরা নূর। এরপরেই মঞ্চে আসে ব্যান্ড দল জলের গান। আরও গান শুনিয়েছেন তপন চৌধুরী, মাহমুদুজ্জামান বাবু, সজীব, ঐশী ও দিনাত জাহান। এরপর কোনাল, ইমরান ও কনার গান দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।

রাজশাহীতে

রাজশাহীতে বর্ণমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর একুশের গান বেহালায় করুণ সুরে বেজে ওঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’। এর সুর বাদন করেন ইকবাল মতিন। আবৃত্তি করে রাজশাহী আবৃত্তি পরিষদের খুদে আবৃত্তিশিল্পীরা। নজরুলসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রেজাউল করিম এবং রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন রেখা পারভীন।

আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশন করে রাজশাহী সরকারি পিএন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। গান ও নাচের পরিবেশনা ছিল রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া নগরের বিভিন্ন স্কুলের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গীত পরিবেশন করে। রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা গান নিয়ে মেলা মাতিয়ে যায় গানের দল মাথল। নৃত্য পরিবেশন করেন ল্যাডলী মোহন মৈত্র ও আলো রানী মৈত্র। শিশুদের জাদু দেখিয়ে মুগ্ধ করে রাখেন জাদুশিল্পী স্বপন দিনার। বিকেলে গান করেন নকশীকাঁথা ব্যান্ডের ভোকাল সাজেদ ফাতেমী। এরপর গান নিয়ে আসেন অঙ্কন, চ্যানেল আই খুদে গানরাজ পায়েল, সংগীতশিল্পী মেহেদী, রোমেল, আরিফ, রাফাত ও ইতি। অনুষ্ঠানের সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল ব্যান্ড দল আনন্দনগরের।