পর্যটনকেন্দ্র গড়ার আগেই বারেক টিলায় দখলের থাবা

সবুজে মোড়া উঁচু টিলার একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে স্বচ্ছ জলের নদী। টিলার ওপর দাঁড়ালে হাতছানি দেয় মেঘ-পাহাড়। এমন একটি স্থান ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। কিন্তু সেই কাজ শুরুর আগেই দখল হয়ে যাচ্ছে টিলাটি।
হাওর-নদী-পাহাড়ের এই অপরূপ সৌন্দর্যের এ লীলাভূমির নাম বারেক টিলা। অবস্থান সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়দল উত্তর ইউনিয়নের লাউড়েরগড় এলাকায় ভারত সীমান্ত ঘেঁষে।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বারেক টিলাকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এখানে নতুন করে কিছু ঘরবাড়ি-দোকানপাট গড়ে উঠেছে শুনেছি। তবে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার কাজ শুরু হলে সব দখলমুক্ত করা হবে।’
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর তাহিরপুরে এসে বারেক টিলা ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার ঘোষণা দেন। এর আলোকে ২০১৩ সালে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বারেক টিলায় ২০ একর ও পার্শ্ববর্তী টাঙ্গুয়ার হাওরপারের টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প এলাকায় ২০ একর জমি অধিগ্রহণ করে জেলা প্রশাসন। ২০১৬ সালের ২০ জুন মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে বারেক টিলার ৫০ শতক জমিতে ‘আমব্রেলা প্রকল্প’ স্থাপনের কথা বলেছে। কিন্তু এখনো কোনো কাজ শুরু হয়নি।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বারেক টিলায় মোট ৩১২ একর জমি আছে। এখানে দীর্ঘদিন ধরে কিছু আদিবাসী পরিবার বাস করে আসছে। টিলায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র ও উপাসনালয় (গির্জা) রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সরকারি কর্মকর্তারা কয়েক দফা এলাকার পরিদর্শন করে গেছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বারেক টিলার পূর্বে যাদুকাটা নদী। উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। পশ্চিমে কয়েকটি আদিবাসী গ্রাম। গ্রামের পরে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প, তার দক্ষিণে টাঙ্গুয়ার হাওর। সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এলাকাটি। টিলার ওপর নতুন করে বেশ কিছু ঘরবাড়ি হয়েছে। টিলার মাঝখান দিয়ে একটি ছোট রাস্তা গেছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। এই পথ দিয়েই টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প ও বড়ছড়া-চারাগাঁও শুল্ক স্টেশনে যাতায়াত করতে হয়।
টিলার মাঝামাঝি স্থানে রাস্তার পাশে মুদি দোকান দিয়েছেন রোমেনা বেগম (৪২)। তাঁর স্বামী জয়নাল মিয়া পাশের যাদুকাটা নদীতে বালু তোলার কাজ করেন। একজনের কাছ থেকে টিলার কিছু জমি ‘কিনে’ ঘর করেছেন তাঁরা। সরকারি টিলার জমি কেনা প্রসঙ্গে রোমেনা বলেন, ‘কাগজপত্র কোনো কিছু নাই। সরকার তুলে দিলে আবার গ্রামে চইলা যাইমু।’
ওই দোকান থেকে একটু সামনে গিয়ে আরেক দোকানে কথা হয় নজরুল ইসলামের (৭০) সঙ্গে। তিনি টিলায় আছেন প্রায় ৩০ বছর। বেশ কিছু জমি তাঁর দখলে ছিল। তিনি অন্যদের কাছে তা বিক্রি করেছেন। নজরুল ইসলাম বললেন, এখানে জমি বিক্রি নয়, শুধু জমির দখল বিক্রি হয়। টিলার ওপর বর্তমানে ৩০০-৪০০ পরিবার আছে। তাদের অনেকেই এসেছে পাশের মাহারাম গ্রাম থেকে। কেউ কেউ নতুন ঘর করেছে। অন্যরা আছে দীর্ঘদিন।
টিলার ওপর নতুন করে ঘর তুলছেন মহারাম গ্রামের আবুল মছব্বির। বাঁশের খুঁটিতে ওপরে টিনের চালা দিয়েছেন; বেড়া দেননি। তিনি জানালেন, রহিম মিয়া নামের একজনের দখলে থাকা ১০ শতক জমি আট হাজার টাকায় কিনেছেন তিনি। তাঁর পাশেই সালেক মিয়া নামের এক ব্যক্তি টিলার ওপর নতুন করে আরেকটি ঘর তোলার কাজ করছেন।
টিলার বাসিন্দা ১০-১২ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগে এখানে ভূমিহীন ও দরিদ্র লোকজন ঘরবাড়ি করতেন। পর্যটনকেন্দ্র হওয়ার কথা শুনে এখন প্রভাবশালীরাও টিলা দখলে নেমেছেন। তেমন একজন লিয়াকত আলী। তিনি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাহের আলীর ছেলে। প্রায় সাত একর জমি দখল করে চারপাশে বেড়া দিয়ে একটি টিনের ঘর করেছেন লিয়াকত। তবে তিনি বলেন, ‘দখল নয়, আমি একজনের কাছ থেকে (জমিটি) কিনেছি।’
বারেক টিলার পার্শ্ববর্তী রাজাই গ্রামের বাসিন্দা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতা ও বাপার সদস্য এন্ড্রু সলমার বলেন, ‘বারেক টিলা ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে কারও আপত্তি নেই। তবে প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়, এমন কাজ করা যাবে না। পাশাপাশি যুগ যুগ ধরে যেসব আদিবাসী পরিবার এখানে বাস করছে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, বারেক টিলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবার ও কোনো ভূমিহীন থাকলে, তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টা অবশ্যই মাথায় রাখা হবে।