বারবার নাশকতায় অচল মহাসড়ক

সীতাকুণ্ডে একের পর এক নাশকতায় কার্যত অচল হয়ে পড়েছে দেশের ‘লাইফ লাইন’ খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। গত ১০ মাসে সহিংসতায় এই উপজেলায় সাতজন প্রাণ হারিয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। হামলাকারীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি গবাদিপশুও। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার উপজেলার ফৌজদারহাটে গরুবাহী ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা হলে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায় সাতটি গরু। এ ঘটনায় ট্রাকের চালক ও সহকারীও মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের মতে, এসব ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা জড়িত। মূলত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই সীতাকুণ্ডে জামায়াত-শিবিরের উত্থান ঘটেছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। কেবল তা-ই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার জামায়াত-শিবির কর্মীদের ছাড়িয়ে নিতেও তৎপর ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।
আগুন ও ভাঙচুর: ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ও বাসমালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী সীতাকুণ্ডে গত ১০ মাসে আগুন দেওয়া হয় ২১৯টি গড়িতে। ভাঙচুর করা হয় প্রায় এক হাজার ৩০০টি গাড়ি।
গ্রেপ্তার-জামিন-ফের নাশকতা: চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মহাসড়কে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে ১০৮টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে ঘুরেফিরে ৪৯৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। সহিংসতা শুরুর পর থেকে পুলিশের ব্যাপক অভিযান চললেও অপরাধীরা জামিনে বের হয়ে ফের নাশকতায় যুক্ত হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ।
বিরোধী দলের পাঁচজনসহ সাতজন খুন: চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়েছেন সাতজন। গত মে মাসে খুন হন ভাটিয়ারী আওয়ামী লীগের নেতা মো. শফি, পরের মাসে খুন হন পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. সোহেল। আগস্টে খুন হন জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ আল রাসেল ওরফে বাবু. আবু বক্কর ছিদ্দিক ওরফে পারভেজ। নভেম্বর মাসে খুন হন বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি আমিনুল ইসলাম ও মুরাদপুর স্বেচ্ছাসেবক দলের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শরীফুল ইসলাম। এ ছাড়া ডিসেম্বর মাসে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন শিবির নেতা মো. রাসেল।
ঘরবাড়ি ছাড়ছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা: গত নভেম্বর মাসে জামায়াত নেতা আমিনুল খুনের পর বাড়বকুণ্ড ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছাদাকাত উল্ল্যাহসহ নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালান জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এ সময় প্রায় ১১ জন গুলিবিদ্ধ হন। এই ঘটনার পর অনেক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ভয়ে এলাকা ছেড়েছেন।
রাবণ-সীতা একাকার: সীতাকুণ্ডে নাশকতার অভিযোগে কেউ আটক হলে সরকারি দল থেকে ছাড়ানোর তদবির শুরু হয়, যা পুলিশও স্বীকার করেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দীন বলেন, ‘উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের ছয়টির চেয়ারম্যান ও একটি পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ সমর্থক। এমন সাংগঠনিক ভিত্তি থাকার পরও নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই সীতাকুণ্ডে জামায়াত-শিবিরের উত্থান ঘটেছে।’
নাশকতার বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক রবিউল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের অধিকার আদায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এমনকি আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা আত্মরক্ষার্থে তার জবাব দিই।’
তবে এত কিছুর পরেও স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করছেন সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রুখতে বিজিবি ও র‌্যাবের ক্যাম্প স্থাপন করা হয় সীতাকুণ্ডে। জামায়াত-শিবির, বিএনপি হামলা চালায় চোরাগোপ্তাভাবে। যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইফতেখার হাসান প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াত-শিবির কর্মীদের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ করে অর্থনৈতিকভাবে দেশকে দুর্বল করা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতায় এখন নাশকতা কমে গেছে।