পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য দরকার সচেতনতা

গোলটেবিল ​বৈঠকে গতকাল বক্তব্য দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক (ডানে)। পাশে এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ l ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল ​বৈঠকে গতকাল বক্তব্য দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক (ডানে)। পাশে এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ l ছবি: প্রথম আলো

কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে মালিক ও শ্রমিকের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন আছে। তবে মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করা না গেলে কেবল আইন দিয়ে কিছু হবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের লোকবল তিন গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সারা দেশে ৮৩ লাখ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান আছে। অধিদপ্তরের পক্ষে এতগুলো প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা কঠিন।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে গতকাল রোববার বিকেলে আয়োজিত ‘কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
শ্রমিকদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তায় মালিক ও শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার কথাও বলেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী। তিনি জানান, শ্রমিকদের স্বল্পমূল্যে পেশাগত রোগের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে দুটি ৩০০ শয্যার হাসপাতাল করছে সরকার। তা ছাড়া নারী শ্রমিকদের জন্য তিনটি ডরমিটরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পোশাকশিল্পের পাশাপাশি অন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় জোর দেওয়ার কথা বলেন গোলটেবিলের বক্তারা। তাঁরা পুরো বিষয়টিকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা এবং সেখানে শ্রমিক প্রতিনিধির অংশগ্রহণের ওপর জোর দেন। এ ছাড়া পোশাক কারখানার চলমান সংস্কার কার্যক্রম, পোশাকের দাম, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরে প্রস্তুতিতে ঘাটতি ও ধলেশ্বরী নদীদূষণ—এসব বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে।
ময়মনসিংহে পরিবেশবান্ধব বস্ত্রকল এনভয় টেক্সটাইলের সব শ্রমিকের জন্য আবাসনব্যবস্থা আছে। তা ছাড়া কারখানা চত্বরে আছে ইকোপার্ক, ব্যায়ামাগার, সিনেমা হলের মতো উন্নত সুযোগ-সুবিধা। এসব তথ্য উল্লেখ করে এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক ও পরে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ঠিকঠাক করতে হবে। এ জন্য সবার নিজের দায়িত্ব পালন করার ইচ্ছা থাকতে হবে। এখানে ইচ্ছাটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য প্রত্যেক পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা হচ্ছে বলে জানান তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির। তিনি বলেন, আইএলওর সঙ্গেও আমাদের কিছু প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শিল্পের স্বার্থেই শ্রমিকদের সুস্থ রাখতে হবে।
আইএলওর জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা স্টিভ নিডহ্যাম বলেন, গত চার বছরে নিরাপত্তা ইস্যুতে অনেক কাজ হয়েছে। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, এখানে মালিকপক্ষের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই। তবে কারখানার নিরাপত্তা কমিটিকে শক্তিশালী করা গেলে সুফল পাওয়া যাবে।
পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে দুটি আলাদা বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রোলমডেল। তবে পেশাগত রোগ সম্পর্কে মালিক ও শ্রমিক কেউ জানে না।
কারখানার সংস্কারকাজ নিয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সদস্য কারখানাগুলো বড় আকারের। তাদের ত্রুটির সংস্কার চলতি বছরে শেষ হয়ে যাবে। তবে জোটের বাইরে থাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো সংস্কারকাজে পিছিয়ে আছে। দাতা সংস্থা তহবিল দিলেও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে কারখানাগুলো ঋণ নিতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমরা কারখানা সংস্কার করছি। বিদেশি ক্রেতারা কথা দিয়েছিল তারা টাকা দেবে। তবে ক্রেতারা সে রকম সহায়তা দেয়নি। উল্টো পোশাকের দাম ২০-২৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে।’
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘সর্বোচ্চ মানের পরিবেশবান্ধব কারখানা আছে বাংলাদেশে। আমরা ভালো জায়গায় আছি। তবে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। কারণ এমন সব নিয়মকানুন তৈরি করা হয়েছে, যাতে ছোট কারখানা টিকতে পারবে না। তাদের ব্যাংক সহায়তা দেওয়া দরকার।’
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনার অধীনে প্রকল্প আকারে হচ্ছে। এটিকে দীর্ঘমেয়াদি রূপ দিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে প্রকল্প শেষ হলে আবার শ্রমিক ঝুঁকির মুখে পড়বে।’ তিনি বলেন, কারখানায় কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের অনেক ধরনের রোগ হয়। ট্রেড ইউনিয়ন ও নিরাপত্তা কমিটি আছে এমন কারখানায় এসব বিষয়ে কিছু কাজ হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যেসব কারখানায় স্বাস্থ্যঝুঁকি কিংবা সক্ষমতা বেশি সেসব কারখানায় আগে কাজ করতে হবে। এ জন্য একটি কাঠামো করতে হবে। এটি বাস্তবায়ন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা যায়।
কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অর্থায়নের সক্ষমতাকে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন আইএলওর বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার লুইস ভেনগাস। তিনি বলেন, বিদেশি ক্রেতারা নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রামের আওতায় ১২০টি কারখানায় মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ চলছে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সেলিমা আহমাদ বলেন, বিজিএমইএ ভালো কিংবা খারাপ করলে সব সময় বড় করে দেখা হয়। বিজিএমইএ যতটা কদর পায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তেমনটা পায় না। তিনি বলেন, শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করা গেলে আমাদের কল্যাণ হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার পেছনে খরচকে বড় কারখানাগুলো বিনিয়োগ হিসেবে নিয়েছে। তবে মাঝারি কারখানার মালিকদের আমরা এখনো বিষয়টি বোঝাতে পারিনি।’
আইএলওর সিনিয়র লেবার ইন্সপেক্টর অ্যান্ড ওএসএইচ অ্যাডভাইজর আলবার্টো সারডা বলেন, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় অনেক কাজ করেছে বাংলাদেশ। তবে আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। এখনো অনেক কাজ বাকি। তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে শিল্পের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি টেকসই হবে না।