তিন বছর পর জেলেদের মুখে হাসি

হালদা নদীতে গত শুক্রবার রাতে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। ডিম সংগ্রহ করতে নদীতে ভিড় করেন জেলেরা। ছবিটি গতকাল হাটহাজারীর গড়দুয়ারা এলাকা থেকে তোলা l সৌরভ দাশ
হালদা নদীতে গত শুক্রবার রাতে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। ডিম সংগ্রহ করতে নদীতে ভিড় করেন জেলেরা। ছবিটি গতকাল হাটহাজারীর গড়দুয়ারা এলাকা থেকে তোলা l সৌরভ দাশ

পরপর তিন বছর প্রায় শূন্য হাতে হালদা নদী থেকে বাড়ি ফিরতে হয়েছে পরিমল দাসকে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা তিনি। তাঁর পরিবার কয়েক পুরুষ ধরে হালদা থেকে মা মাছের ডিম সংগ্রহ করে। মা মাছ আগের মতো ডিম না ছাড়ায় এবারও আশা ছিল না তাঁর। তবে শুক্রবারের বজ্রবৃষ্টি পরিমলদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ হয়েই যেন এসেছিল। ওই দিন মধ্যরাতে ডিম ছেড়েছে হালদার মা মাছেরা। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহ করতে পেরে খুশি হালদাপারের জেলে ও মৎস্যচাষীরা।
দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যেই হালদা নদীতে একাধিকবার ডিম ছাড়ে মা মাছ।
হালদাপারের জেলেরা বলেন, কয়েক দিন ধরেই অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। প্রতিদিন ডিঙি নৌকা নিয়ে নদীতে চক্কর দিতেন। গত শুক্রবার রাতে সে অপেক্ষার শেষ হয়। রাত ১২টার পর থেকে ডিম ছাড়া শুরু করে মা মাছ। আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া জেলে ও মৎস্যচাষিরা ঝটপট নেমে পড়েন জাল আর নৌকা নিয়ে। রাতভর ডিম আহরণ শেষে গতকাল শনিবার সকাল থেকেই হাটহাজারীর বিভিন্ন মৎস্যকেন্দ্রে আসতে শুরু করেন জেলেরা।
গতকাল সকাল ১০টায় হাটহাজারীর মদুনাঘাট প্রাকৃতিক রেণু ও পোনা উৎপাদনকেন্দ্রে দেখা যায়, আহরণ করা ডিম পরিচর্যায় ব্যস্ত জেলেরা। ডিম থেকে রেণু ফোটানো হবে। রাতভর ডিম আহরণের পরও ক্লান্তি ছিল না তাঁদের চেহারায়। একই চিত্র ছিল উপজেলা শাহমাদারি মৎস্য সমিতি কেন্দ্রেও। হাটহাজারী মৎস্য কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, সকাল ১০টার মধ্যে ওই কেন্দ্রে তিন শ বালতি ডিম সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।
গত তিন বছর হালদা থেকে কী পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে তা নিয়ে অবশ্য দুই রকম হিসাব পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কার্যালয় জানায়, ২০১৪ সালে হালদা থেকে সংগ্রহ করা ডিমের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৪৮০ কেজি, ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৩৬০ কেজি, ২০১৬ সালে ছিল ৭ হাজার ১৬৫ কেজি। আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদার গবেষক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ২০১৪ সালে ডিম সংগ্রহ করা গেছে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭২০ কেজি।
গতকাল মোট কী পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা গেছে তার হিসাব এখনো হয়নি বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মমিনুল হক। তিনি বলেন, অন্য বছরের তুলনায় বেশি ডিম ছেড়েছে মা মাছ। তবে কী পরিমাণ ছেড়েছে, তা জানতে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
অবশ্য গত তিন বছরের তুলনায় যে ডিমের পরিমাণ বেশি ছিল, জেলেদের চওড়া হাসিই তা জানান দিচ্ছিল। মিন্টু বড়ুয়া নামের এক জেলে বলেন, এবার প্রথম দিনেই ১৪ বালতি ডিম আহরণ করা গেছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই বেশি ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন তিনি।
ডিমের পরিমাণ বাড়লেও এবার ডিম আহরণকারী জেলেদের সংখ্যা কম ছিল বলে জানান মনজুরুল কিবরীয়া। ডিম ছাড়ার খবর পেয়ে গতকাল ভোরেই হালদাপারে যান তিনি। মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘গত বছর ২৬৫টি নৌকা ডিম আহরণ করেছে। এবার করেছে মাত্র ১০৫টি নৌকা। গতবার ডিম না পাওয়ায় এবার জেলেরা আর এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে সাহস পায়নি। যদি বেশি জেলে নামত, তাহলে ডিম সংগ্রহ আরও বেশি হতো।’
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার রাত একটার দিকে বেশি ডিম পাওয়া গেছে। হাটহাজারীর আজিমের ঘাট, নাপিতের ঘাট, আমতুয়ার ঘাট ও মদুনাঘাট এলাকায় ডিম বেশি পাওয়া গেছে। এবার রাউজানের দিকে ডিম কম পাওয়া গেছে। ডিম থেকে রেণু ফোটাতে তিন দিন সময় লাগবে। এরপর এগুলো বিক্রি করা হবে। এক মাস পর আবারও ডিম পাওয়ার আশা করছেন জেলেরা।