দাদনের শিকলে বাঁধা ইটভাটার শ্রমিকেরা

বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ইটভাটায় ঝুপড়িঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাস করেন ইটভাটার শ্রমিকেরা। ছবি: আসাদুজ্জামান
বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ইটভাটায় ঝুপড়িঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাস করেন ইটভাটার শ্রমিকেরা। ছবি: আসাদুজ্জামান

বুড়িগঙ্গার তীরে বাঁশের তৈরি ছোট্ট ছোট্ট ঘরের সারি। প্রতিটি ঘরের দৈর্ঘ্য ১০ ফুট। উচ্চতা পাঁচ ফুট। এমনই এক ঝুপড়িঘরে দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন গোলাপ মিয়া। 

ঘরের খুব কাছে ইটখোলা। ভোর পাঁচটায় হাজির হন গোলাপ। এরপর ৮–১০ খানা ইট মাথায় নিয়ে শুরু হয় তাঁর কাজ। বিরতিহীনভাবে ইট টানেন সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। সব মিলিয়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার ইট টানতে পারেন। বিনিময়ে পান মাত্র ১৫০ টাকা। এ টাকায় তাঁর সংসার আর চলছে না। তবু ইটখোলা ছেড়ে যেতে পারছেন না। কারণ, ১০ হাজার টাকার দাদনের শিকলে তাঁর হাত-পা বাঁধা।
গোলাপ মিয়ার মতো রাজধানীর আশপাশের ৮০০ ইটখোলায় এক লাখের বেশি শ্রমিক দাদনের শিকলে বন্দী আছেন। শ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। সরেজমিন রাজধানীর কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের ইটভাটাগুলোতে গিয়ে পাওয়া গেছে এই চিত্র।

কেরানীগঞ্জের জাজিরার চরে এই তিন শ্রমিক সকাল-সন্ধ্যা এক হাজার ইট টেনে পান মাত্র ১০০ টাকা। ছবি: আসাদুজ্জামান
কেরানীগঞ্জের জাজিরার চরে এই তিন শ্রমিক সকাল-সন্ধ্যা এক হাজার ইট টেনে পান মাত্র ১০০ টাকা। ছবি: আসাদুজ্জামান

দাদনের জালে জড়িয়ে হাঁসফাঁস করা গোলাপের মতো শ্রমিকদের কথা জানানোর পরপর বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির মহাসচিব আবু বকর প্রথম আলোকে বলেন, ইটখোলায় শ্রমিকের বড় অভাব। তাই শ্রমিকদের অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়। এই টাকার নামই দাদন। দাদনের টাকা আর শ্রমিককে ফেরত দিতে হয় না। দাদন নিয়ে শ্রমিকেরা ইটখোলায় কাজ করে ভালো টাকা উপার্জন করছেন।
ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির এই নেতার ভাষায়, দাদন হলো ‘ফাও টাকা’। তিনি বললেন, মালিকেরা শ্রমিকদের লাখ লাখ টাকা দাদন দিয়ে থাকেন। তবে দাদন নিয়েও অনেকে কাজে আসেন না।
ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকার আশপাশে ৮০০ ইটখোলা রয়েছে। প্রতিটি খোলায় কমপক্ষে ২০০ শ্রমিক কাজ করছেন। সেই হিসাবেই রাজধানীতে ১ লাখ ৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, দাদন দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করাতে বাধ্য করানো রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ। দেরি না করে অবিলম্বে সরকারের উচিত এসব মালিক ও সরদারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

ইটভাটার শ্রমিকদের সন্তানেরা। ছবি: আসাদুজ্জামান
ইটভাটার শ্রমিকদের সন্তানেরা। ছবি: আসাদুজ্জামান

ঢাকার কেরানীগঞ্জের জাজিরার চরের ইটখোলাতে গিয়ে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার তীরের ইটভাটাগুলোতে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের অধিকাংশ এসেছেন কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলা থেকে। প্রত্যেক শ্রমিক ছয় হাজার থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাদন নিয়েছেন। ইট তৈরি থেকে ইট পোড়ানোর কাজে নিয়োজিত এই শ্রমিকেরা গড়ে চার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে থাকেন। শ্রমিকেরা বুড়িগঙ্গার তীরে ইটখোলায় ছোট্ট ছোট্ট ঘর তৈরি করে পরিবার নিয়ে থাকছেন। সেখানে শত শত শিশু মা-বাবার সঙ্গে থাকছে। ৮ বছর থেকে ১৪ বছরের কয়েক শ শিশু মা-বাবার সঙ্গে ইট টানার কাজ করছে।

শ্রম আইন বলছে, একজন শ্রমিক প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করবেন। কিন্তু ইটখোলার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইটখোলার শ্রমিকদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। তবে ইট তৈরি ও ইট বানানোর কাজ শুরু হয় খুব সকালে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই কার্যক্রম। আর ইট পোড়ানোর কাজে শ্রমিকেরা পালা করে দিন-রাত কাজ করেন। ইট তৈরি ও টানার ওপর ভিত্তি করে শ্রমিকদের মজুরি ঠিক হয়। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর মজুরি পান মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।

ঝুপড়িঘর আর খোলা পায়খানায় প্রাতঃকৃত্য সারেন শ্রমিক ও তাঁদের সন্তানেরা। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঝুপড়িঘর আর খোলা পায়খানায় প্রাতঃকৃত্য সারেন শ্রমিক ও তাঁদের সন্তানেরা। ছবি: আসাদুজ্জামান

দাদনের শিকল ও সরদার: ঢাকায় ইটভাটাগুলোতে কয়েক বছর ধরে দাদনব্যবস্থা চালু রয়েছে। শ্রমিক না পাওয়ায় ইটখোলার মালিকেরা দাদনের লোভ দেখিয়ে শ্রমিকদের কাজে আনেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেল, শ্রমিকেরা মালিকের কাছ থেকে দাদন নেন না। দাদন দেন সরদার। সরদার হলেন শ্রমিকদের এলাকার একজন, যিনি ইটখোলার মালিকের কাছ থেকে টাকা নেন। প্রত্যেক ইটখোলার মালিক প্রতিবছর শ্রমিক কেনার জন্য সরদারদের ২০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন দেন। সরদারেরা যাঁর যাঁর এলাকা থেকে শ্রমিকদের দাদনের প্রলোভন দেখিয়ে কাজে নিয়ে আসেন।
জাজিরার চরে বাদশা ইটখোলার সরদার আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কিশোরগঞ্জ থেকে ৬০ জন শ্রমিক নিয়ে এসেছেন। প্রত্যেক শ্রমিককে তিনি ১২ হাজার টাকা দাদন দিয়েছেন। আর এসব শ্রমিক গড়ে মাসে চার থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করেন। তবে কাজ ছেড়ে চলে যেতে চাইলে দাদন হিসেবে নেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে যেতে হবে।
জাজিরার এএএম ইটভাটার মালিক আবদুল ওহাব বলেন, চলতি বছর তিনি শ্রমিকদের দাদন দিয়েছেন ২০ লাখ টাকা। আর ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির নেতা আবু বকর বলেন, শ্রমিক-সংকট। বাধ্য হয়ে প্রত্যেক মালিক প্রতিবছর ৩০ থেকে ৬০ লাখ টাকা শ্রমিকদের দাদন দিয়ে থাকেন। তিনিও ২০ লাখ টাকা দাদন দিয়ে শ্রমিক এনেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেল, ইটখোলায় ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম। শ্রমিকেরা সাধারণত কাজ করতে চান না। তাই দাদনের লোভ দেখিয়ে শ্রমিক আনা হয়।

ইটভাটার শ্রমিকেরা কয়লা তোলার কাজে ব্যস্ত। ছবি: আসাদুজ্জামান
ইটভাটার শ্রমিকেরা কয়লা তোলার কাজে ব্যস্ত। ছবি: আসাদুজ্জামান

শ্রমিকের মন পুড়িয়ে ইটের মুনাফা: ইটের মাটি ট্রলারে করে আনেন একদল শ্রমিক। আরেক দল মাটি প্রস্তুত করেন। আরেক অংশ ইট বানান। এরপর পোড়ানো হয় সেই ইট। শ্রমিক, সরদার ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাধারণত এক নম্বর একটি ইট তৈরিতে মালিকের খরচ পড়ে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। কিন্তু একটি ইট সাত থেকে আট টাকায় বিক্রি হয়। ইট কিনতে সিলেট থেকে ঢাকায় চলে আসেন ক্রেতারা। আহম্মেদ নামের একজন শ্রমিক বলছিলেন, ইটখোলায় কাজ করা যে কত কষ্টের, তা বোঝানোর ভাষা তাঁর নেই। এত কষ্ট করেও যে টাকা পান, তা দিয়ে সংসার চলে না। মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু দেখার কেউ নেই।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) মহাপরিদর্শক মো. সামছুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, আজকালের মধ্যেই ইটখোলায় তিনি তাঁর কর্মকর্তাদের পাঠাবেন এবং অবৈধ দাদন দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করানো মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।