ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজারে ৫২ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত

ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে গাছ চাপা পড়ে কক্সবাজারে শিশু, নারীসহ চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে অন্তত ৬০ জন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার ৮টি উপজেলার প্রায় ৫২ হাজার ঘরবাড়ি। ভেঙে গেছে দুই লাখের বেশি গাছপালা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ সূত্রে ক্ষয়ক্ষতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।

ঘূর্ণিঝড়ে গাছচাপায় নিহত চারজন হলো চকরিয়া উপজেলার ভেউলা মানিকচর এলাকার সায়েরা খাতুন (৬৫), একই উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের রহমত উল্লাহ (৪৫), কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের শাহিনা আক্তার (১০) ও পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া এলাকার আবদুল হাকিম (৫০)।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ৫২ হাজার ঘরবাড়ির মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ১৭ হাজার ২৩টি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৫২ হাজার ৫৩৯। ঝড়ে গৃহহীন হয়ে পড়া কয়েক হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে বাস করছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ১১০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৯ লাখ টাকা, ৭০০ প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী, ৩০০ কেজি চিড়া, ২০০ কেজি গুড় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে গতকাল সকাল থেকে কক্সবাজার শহরসহ আশপাশের এলাকায় বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ ছিল। ঝড়ে গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে গতকাল রাত আটটায় প্রথম আলোকে জানান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, শহরের কিছু এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকে বিদ্যুতের সংযোগ চালু করা সম্ভব হয়েছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তাঁরা কাজ করে চলেছেন।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোরার প্রভাবে গত সোমবার সন্ধ্যার পর কক্সবাজার উপকূলে ১০ নম্বর মহা বিপৎসংকেত জারি করা হয়। রাতের মধ্যে জেলার উপকূলীয় এলাকা থেকে অন্তত তিন লাখ মানুষকে সরিয়ে আনা হয়। গতকাল ভোরে ঘূর্ণিঝড় মোরা কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানতে থাকে। তখন সাগরে ভাটা থাকায় জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে উপকূলের মানুষ রক্ষা পেয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান। ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে টেকনাফ ও কুতুবদিয়া উপজেলায়।

কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আ স ম শাহরিয়ার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। ইউনিয়নের পশ্চিম চর ধুরুং এলাকায় আধা কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। মাত্র ১০ দিন আগে এই বেড়িবাঁধটি সংস্কার করা হয়।

গতকাল দুপুরে কক্সবাজার শহরের পৌর প্রিপারেটরি উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে কথা হয় সেখানে আশ্রয় নিতে আসা গৃহবধূ রাশেদা বেগমের (৪৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, পাঁচ মেয়ে নিয়ে সোমবার রাতে এখানে আসেন তিনি। তাঁর বাড়ি শহরের নাজিরারটেক সমুদ্র উপকূলে। রাতে বিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষ আশ্রয় নেয়। মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে সবাই চলে গেলেও তিনি যেতে পারছেন না। কারণ, তাঁর ঘর ভেঙে গেছে।

টেকনাফে ৬ হাজার ঘরবাড়ি বিলীন

ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে টেকনাফের অন্তত ৬ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। প্রায় ৬০০ পানের বরজ ধসে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও সাবরাং ইউনিয়নে।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ১ হাজারের মতো ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। কয়েক শ গৃহহীন মানুষ সেন্ট মার্টিন হাসপাতালসহ বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ৬ হাজার ১০০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য ১৩ মেট্রিক টন চাল ও শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। খুঁটি ভেঙে পড়ায় উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সামনে বিশাল একটি আকাশমণিগাছ ভেঙে বিধ্বস্ত হয়েছে পাশের শিশু একাডেমীর একতলা ভবন। টেকনাফ বাসস্টেশনের রাজমনি হোটেলের চতুর্থ তলায় স্থাপিত মুঠোফোন সেবাদাতা একটি প্রতিষ্ঠানের টাওয়ার ভেঙে গেছে।

চকরিয়া ও পেকুয়ায় বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন

কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সড়কের ওপর গাছ পড়ে গতকাল সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ ছিল। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সড়ক থেকে গাছ সরানোর ব্যবস্থা করেন। ঝড় শুরু হওয়ার পর থেকে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দেয়।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, চকরিয়া কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক আবদুস সামাদ বলেন, তারে গাছ পড়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বিদ্যুতের সংযোগ স্বাভাবিক হতে আরও এক দিন লাগতে পারে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চকরিয়া উপজেলায় ১০ হাজার ২২৮টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ১৯৩টি, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৩৫টি। চকরিয়া পৌরসভায় ৮০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ বলেন, ৭ ইউনিয়নে অন্তত ৬০০ ঘরবাড়ি, ৯৫টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩ হাজারের বেশি গাছ ভেঙে গেছে। বিদ্যুতের তারের ওপর গাছ পড়ে প্রায় পুরো উপজেলা গতকাল দিনভর বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে।