বরিশালের 'যুবরত্ন' সাদিক আবদুল্লাহ!

সাদিক আবদুল্লাহ
সাদিক আবদুল্লাহ

বরিশাল শহরের বিবির পুকুরপাড়ে ঝুলছে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বিশাল ছবি। শহরজুড়ে নেতা-কর্মীদের পোস্টার-ব্যানারেও তিনি আছেন। রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডের পাশে মোটরসাইকেল মালিক ও চালক সমিতির কার্যালয়ের সাইনবোর্ডেও সাদিক আবদুল্লাহর ছবি।

জানতে চাইলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মামুন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, সাদিক সাহেবই তো আগামী দিনের নেতা। দল প্রার্থী করলে তিনি মেয়রও হবেন।

স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনীতিবিদেরা বলছেন, অল্প সময়ে বরিশালের রাজনীতিতে একচ্ছত্র হয়ে উঠেছেন সাদিক আবদুল্লাহ। পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর পর এখন তিনিই বরিশালের আলোচিত নেতা। তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত মহানগর আওয়ামী লীগ। শুভাকা‌ঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে ‘যুবরত্ন’ উপাধিও পেয়েছেন তিনি।

রাজনীতিতে মাত্র তিন বছরেই উত্থান সাদিক আবদুল্লাহর। গত বছরের অক্টোবরে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। তাতে ৩ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পান তিনি। কমিটির ক্রম অনুযায়ী তাঁর অবস্থান ১৪ নম্বরে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তিনিই এখন নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ ব্যক্তি, সবকিছু।

জানতে চাইলে ‘যুবরত্ন’ উপাধি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন সাদিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুবরত্ন’ উপাধিটি দিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হক। কোনো উপাধি পেলে তা শুনতে তো ভালোই লাগে।

জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর তিন ছেলের বড়জন সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। অন্য দুই ছেলের একজন আশিক আবদুল্লাহ বাবার সঙ্গে সক্রিয় গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায় দলীয় রাজনীতিতে। আরেক ছেলে মঈন আবদুল্লাহ থাকেন ঢাকায়। সাদিক থাকছেন বরিশালেই।

বরিশাল শহরে ঘুরলে পিতা হাসানাত আবদুল্লাহ ও ছেলে সাদিক আবদুল্লাহর প্রভাব চোখে পড়বে। পোস্টার-ব্যানারে পিতা-পুত্রের যুগল ছবির পাশাপাশি আলাদা করে আছেন সাদিক। দেখা যায়, যুগ্ম সম্পাদক সাদিকের দৃষ্টিনন্দন ছবিতে ঢাকা পড়েছেন মহানগর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

এর বাইরে সিটি করপোরেশন, এলজিইডি, পিডব্লিউডি, নৌবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তাঁর উত্থানের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় নাগরিকেরা বলছেন, এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ ঠিকাদারি কাজের ভাগ-বাঁটোয়ারায় সাদিকের নাম ব্যবহৃত হচ্ছে।

জানতে চাইলে সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, ‘যেহেতু মহানগর আওয়ামী লীগে কাজ করি, নগরে কিছু ঘটলে আমার নাম আসে। এটা কীভাবে ঠেকাব? আমি চেষ্টা করছি সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি বন্ধ করতে। যাতে আমার নাম ব্যবহার করে কেউ পার না পায়।’

সাদিক আবদুল্লাহর উত্থান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেন, ২০১৪ সালের এপ্রিলে আকস্মিক মারা যান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র শওকত হোসেন (হিরন)। এরপরই সাদিক বরিশালের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে তৎপর হন। তখন তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে ছিলেন।

দলীয় সূত্র জানায়, হিরনের মৃত্যুর পর মহানগর আওয়ামী লীগ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। গত বছরের ২০ অক্টোবর গোলাম আব্বাস চৌধুরীকে সভাপতি এবং কে এম জাহাঙ্গীর হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। ৭১ সদস্যের এই কমিটিতে নয়জন সহসভাপতি ও তিনজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আছেন। ৩ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক হন সাদিক আবদুল্লাহ। কিন্তু তাঁর উত্থানে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা আড়ালে ঢাকা পড়েছেন। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ-অস্বস্তি থাকলেও কেউ মুখ খুলে বলার সাহস দেখাচ্ছেন না।

সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রার্থী হবেন। নির্বাচনের বাকি আর এক বছর। এখন থেকেই তিনি প্রস্তুতি শুরু করেছেন বলে জানালেন। এ জন্য নগর আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ড-কর্মসূচির নেতৃত্বে থাকছেন।

জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ সদস্য তরুণ চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, সাংগঠনিক যোগ্যতার কারণে নেতা-কর্মীরা সভাপতি-সম্পাদকের চেয়ে সাদিককে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ছাত্র-যুব সবাই তাঁকে ঘিরে আছেন। আওয়ামী লীগে তাঁর বিকল্প মেয়র প্রার্থীও নেই।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, সাদিক আবদুল্লাহ রাজনীতিতে তাঁর আগমন জানান দেন মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি পুনর্গঠনের দুই মাস আগে। গত বছরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীতে হঠাৎ করেই তিনি নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে কর্মসূচি পালন করেন। যদিও ওই সময় তিনি নগর কমিটির কোনো পদে ছিলেন না। এর দুই মাস পর তিনি যুগ্ম সম্পাদকের পদ পান। এর আগেই নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের সভাপতি-সম্পাদকদের দিয়ে সাদিক আবদুল্লাহকে মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক করার আওয়াজ তোলা হয়। এর নেপথ্যে পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ভূমিকা আছে বলে করেন নেতা-কর্মীরা।

তবে সাদিক আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনীতিতে জায়গা পেতে বাবার কোনো সহযোগিতা পাইনি। পেলে তো নেতা-কর্মীদের চাহিদা অনুযায়ী সাধারণ সম্পাদকের পদ পেতাম।’

দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, নগর কমিটিতে পদ পাওয়ার পর গত ২৬ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত সাদিক আবদুল্লাহ বরিশাল শহরে ৩০টি কর্মিসভা করেন। এর কয়েকটিতে ছিলেন এমন একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, এসব সভায় সাদিক আবদুল্লাহর প্রয়াস ছিল নিজেকে একচ্ছত্র নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা। অনেক কর্মিসভায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন না।

জানতে চাইলে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম আব্বাস চৌধুরী বলেন, ‘নেতা-কর্মীদের মধ্যে সাদিকের গ্রহণযোগ্যতা আছে। কর্মীদের আবেগ ও ভালোবাসা তাঁর পক্ষে আছে। আমাদের পরামর্শ ছাড়া সাদিক কোনো সিদ্ধান্ত নেন না।’

স্থানীয়ভাবে বলাবলি আছে, শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর পর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ দুটিই এখন হাসানাত পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। তাঁর স্ত্রী শাহান আরা আবদুল্লাহ একই সঙ্গে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। সাদিক আবদুল্লাহর পাশাপাশি অপর দুই ছেলে আশিক ও মঈন আবদুল্লাহও দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, জীবিত অবস্থায় নগর আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল শওকত হোসেন হিরনের। তখন রাজনৈতিক মহলে এমনও বলাবলি ছিল, হিরনের ব্যক্তি জনপ্রিয়তা বরিশাল আওয়ামী লীগে একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে। হিরনের মৃত্যুর পর এই শূন্যতা পূরণে স্ত্রী জেবুন্নেছা আফরোজ রাজনীতিতে যুক্ত হন। তাঁকে সদর আসনের সাংসদও করা হয়। কিন্তু স্বামীর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। সেই জায়গা দখলে নিয়েছেন সাদিক। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হিরণের অনুসারীরাও সাদিকের সঙ্গে যুক্ত হন। এ ক্ষেত্র পারিবারিক ঐতিহ্য, বিশেষ করে পিতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর আনুকল্য পান সাদিক।

অবশ্য সাদিক আবদুল্লাহর দাবি, ‘শওকত হোসেন হিরন সফল মেয়র এবং মহানগর সভাপতি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর কর্মীদের পাশে থাকছি। স্বাভাবিকভাবেই নেতা-কর্মীরা আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।’

এই বক্তব্যের সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত জানান মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক আফজালুল করীম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মহানগর কমিটির বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মেরুদণ্ডহীন হিসেবে পরিচিত। দল চালাচ্ছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আসলে রাজনীতি নয়, মহানগর আওয়ামী লীগ পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। সরকারের উন্নয়নবান্ধব কর্মসূচির পরিবর্তে সবাই এখন ব্যক্তিবন্দনায় ব্যস্ত।