'রোহিতপুরি লুঙ্গি' নেই তাঁতে, তবে তৈরি কার হাতে?

একদিন বাবুরহাট বাজারে গামছা কিনতে গেছেন ওয়াজউদ্দিন মুন্সি। বেশ খাসা রং। এ গামছা কোন জায়গার? দামদরের আগে জানতে চান মুন্সি সাহেব। বিক্রেতা বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘রোহিতপুরের গামছা।’

‘কী! রোহিতপুরের গামছা? তা রোহিতপুরের কোন জায়গায় এ গামছা তৈরি হয়—বলেন তো?’
‘হ, রোহিতপুরেরই তো। ভুল বলেছি নাকি?’ গর্জে ওঠেন বিক্রেতা।
নরসিংদীর এই ব্যবসায়ীর জানা ছিল না ওয়াজউদ্দিন মুন্সির বাড়ি রোহিতপুর। আর বংশপরম্পরায় তাঁরা তাঁতি। শেষে ওই বিক্রেতা ক্ষমা চান এবং স্বীকার করেন যে এই গামছা রোহিতপুরের নয়।

নারায়ণপট্টির মোহাম্মদ আলীর হাতে চালিত তাঁতযন্ত্র। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান
নারায়ণপট্টির মোহাম্মদ আলীর হাতে চালিত তাঁতযন্ত্র। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান

রোহিতপুরের নারায়ণপট্টিতে নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে কথাপ্রসঙ্গে গল্পটি বলছিলেন ওয়াজউদ্দিন মুন্সি। একসময় তাঁর তিনটি তাঁত ছিল। ২০ বছর যাবৎ একটিও নেই।
মজার ব্যাপার হলো, এখানে তাঁত তেমন না থাকলেও বাজারে রোহিতপুরি লুঙ্গি-গামছার অভাব নেই। তাহলে?
কেরানীগঞ্জের কদমতলী থেকে সাত কিলোমিটার দূরত্বে রোহিতপুর ইউনিয়ন। অটোরিকশায় সময় লাগে ৩০ মিনিট। এই বাজারে বেশ কিছু লুঙ্গি-গামছার পাইকারি দোকান। সব ‘আদি রোহিতপুরি’।

নারায়ণপট্টির তাঁতপল্লি। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান
নারায়ণপট্টির তাঁতপল্লি। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান

তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আগে কথা নয়। আগে কথা হবে তাঁতি আর কারিগরদের সঙ্গে। তাই আগে যাব তাঁতপল্লিতে।
সেই মতো জ্যৈষ্ঠের শেষ দিকে রামেরকান্দা সড়ক ধরে এগিয়ে যাই। এই গ্রাম দিয়েই শুরু হওয়ার কথা তাঁত অঞ্চল। সেই রকমই জেনে এসেছি! কিন্তু পবিত্র ঈদের এই সময়েও খুটখাট, ফুটফাট শব্দ কানে বাজে না।

রামেরকান্দা সড়কের পাশে রং দেওয়ার পর শুকানো হচ্ছে সুতা। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান
রামেরকান্দা সড়কের পাশে রং দেওয়ার পর শুকানো হচ্ছে সুতা। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান

পথে দেখা হয় বৃদ্ধ হাসাবুদ্দিনের সঙ্গে। হন্তদন্ত হয়ে কোথাও যাচ্ছেন। বললেন, ‘এই এলাকায় তো কোনো তাঁত এখন আর নেই। তবু যান নারায়ণপট্টি। যদি দেখা মেলে একটা বা দুইটা।’
রামেরকান্দা থেকে নারায়ণপট্টি রিকশায় ভাড়া ১০ টাকা। এখানে এসে তাঁত ব্যবসায়ী লতিফ ব্যাপারীর খোঁজ করতেই দেখা মেলে ওয়াজউদ্দিন মুন্সির। অভিপ্রায় জেনে তিনিও মাথা নাড়েন। এখানে তাঁত বা তাঁতি নেই। অবশেষে তিনি নিয়ে যান মোহাম্মদ আলীর বাড়ি, যিনি একজন কারিগর। গ্রাম হলেও বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। চিকন সড়ক। গায়ে গায়ে লেগে থাকা একতলা, দেড়তলা বাড়ি।

নারায়ণপট্টিতে নিজের দোকানে মোবারক হোসেন। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান
নারায়ণপট্টিতে নিজের দোকানে মোবারক হোসেন। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান

কিন্তু মোহাম্মদ আলী বাড়িতে নেই। দুদিন তাঁতে বসেন না। খানিকটা দূর থেকে তাঁর বউ বলেন, ‘রাজের জোগালি (রাজমিস্ত্রির সহকারী) দিতে গেছে।’
‘কিন্তু তাঁতযন্ত্রটি তো দেখা যাবে।’ ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘যাবে।’
দেখেই বোঝা যাচ্ছে, যন্ত্রটির বয়স হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটার নাম হ্যান্ডলুম বা হাতে চালিত তাঁতযন্ত্র।
তাঁতঘরে ঢুকে ওয়াজউদ্দিন মুন্সি যেন ফিরে যান যৌবনে, যখন তিনি ছিলেন একজন গর্বিত তাঁতি। পাকা হাতে বানাতেন কত লুঙ্গি, গামছা। ‘এই জিনিসটার নাম মাজন। এটা দিয়ে সুতা মাড় দেওয়া ও ধারালো করা হয়। মাজন বিক্রি হতো শ্রীরামপুর বাজারে (সিরাজদিখান উপজেলা)। আর এই যন্ত্রটার নাম ডগগি। এটা দিয়ে লুঙ্গির পাড়ের নকশি (নকশা) করা হয়।’
মোহাম্মদ আলীরা চার ভাই। দুই ভাই তাঁতের কাজ করেন। দুই ভাই অন্য পেশায়। তবে সুযোগ পেলে মোহাম্মদ আলীও অন্য পেশায় ঢুকে পড়েন। যেমন আজ (মঙ্গলবার) গেছেন। কেন? ভেতর থেকে জবাব আসে, ‘তাঁতে পোষায় না।’

রোহিতপুরের নারায়ণপট্টি। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান
রোহিতপুরের নারায়ণপট্টি। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান

এখানকার প্রবীণ তাঁতিদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, রোহিতপুরের (শব্দটি রুহিতপুরও লেখা হয়) তাঁত ঐতিহ্য প্রায় শত বছরের। আড়াই থেকে তিন হাজার তাঁত ছিল কেবল এই রামেরকান্দা, নারায়ণপট্টিতে। আর এখান থেকে উৎপাদিত তাঁতপণ্যের বাজার বসত রোহিতপুরে। সাপ্তাহিক হাটের দিন মাল আসত হাজারে হাজারে। তাঁতি, পাইকার, ফড়িয়ারা মুখর করে রাখতেন বাজারটি। ভারত, সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় কদর ছিল রোহিতপুরি লুঙ্গির। হ্যান্ডলুমে তৈরি হওয়ায় লুঙ্গি খুব মিহি হতো। ইতিহাসের সেই আনন্দমুখর ঢেউ মিলিয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীতে।
এখন এখানে তাঁতি আছেন বড়জোর ১০ কি ১২ জন। তাঁরা বানান সাদা লুঙ্গি।

রামেরকান্দা সড়কের পাশে রং দেওয়ার পর শুকানো হচ্ছে সুতা। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান
রামেরকান্দা সড়কের পাশে রং দেওয়ার পর শুকানো হচ্ছে সুতা। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান

কেন এমন হলো? এবার যোগ দেন মোবারক হোসেন। তিনি ওয়াজউদ্দিন মুন্সিরই সহোদর। ১৭টি তাঁতের মালিক ছিলেন। এখন নারায়ণপট্টিতে দোকান দিয়ে বসেছেন। দোকানের নাম ‘সোনার বাংলা লুঙ্গি’। তাঁদের ভাষ্য, স্বাধীনতার আগে জাপান, কোরিয়া, পাকিস্তান, মিসর, থাইল্যান্ড থেকে সুতা আসত। সেই সুতায় তৈরি হতো লুঙ্গি। এখন বিদেশি সুতা আগের মতো মেলে না। আর দেশি সুতার দাম বেশি। সেই তুলনায় ব্যবসা জমে না। মোবারক যোগ করেন, ‘পাওয়ার লুম (বিদ্যুৎ-চালিত তাঁত) দিতে পারলে চলত। প্রোডাকশন বেশি হইত। কিন্তু খরচ বেশি। দেবে কেডা।’ আলোচনায় যোগ দেন ইদ্রিস আলী। তাঁর কথা সোজাসাপটা, ‘বিদেশি সুতা আসে না। বাংলাদেশি সুতা চলে না।’

মোহাম্মদ আলীর তাঁতযন্ত্রের সামনে তাঁতি ওয়াজউদ্দিন মুন্সি। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান
মোহাম্মদ আলীর তাঁতযন্ত্রের সামনে তাঁতি ওয়াজউদ্দিন মুন্সি। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান

তবে তাঁত বন্ধ বলে এই এলাকায় অভাব আছে, ব্যাপারটা সে রকম নয়। এই এলাকার যুবকশ্রেণির বড় অংশই প্রবাসী। ইদ্রিস আলীর কথায়, ‘একেকজনের পোলাপান একেক লাইন ধইরা খাইতাছে, কাম কইরা।’ অর্থাৎ যা বোঝা গেল, এখানে তাঁত প্রজন্মেরও বিলুপ্তি ঘটেছে অন্তত দুই-তিন দশক আগে।
তবে বাজারে এত রোহিতপুরি লুঙ্গি কোথা থেকে আসে, কারা বানায়? এ প্রশ্নের উত্তর হলো, ব্যবসায়ীরা পাবনা, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ), রাজশাহী অঞ্চল থেকে পাওয়ারলুমে তৈরি করা লুঙ্গি কিনে এনে ‘আদি রোহিতপুরি’ ট্যাগ বসিয়ে দেন। এটা শুধু এখানকার ব্যবসায়ীরা করেন তা নয়, অন্য ব্যবসায়ীরাও করেন। কোনো পিস সাত শ, কোনোটা হাজার, কোনোটা বারো শয় বিকোয়।

রোহিতপুরে নিজের দোকানে পাইকারি ব্যবসায়ী মুসলিমউদ্দিন। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান
রোহিতপুরে নিজের দোকানে পাইকারি ব্যবসায়ী মুসলিমউদ্দিন। ছবি: কাজী আলিম-উজ-জামান

ফেরার পথে রামেরকান্দায় রাস্তার পাশে দেখা যায় একটি ডাইং কারখানা। সুতায় রং দেওয়া চলছে। ‘মাহাজান’ শিশির আহমেদ নিজেও কাজে নেমে পড়েছেন। মিল থেকে সুতা কিনে রং করে তারপর বিক্রি করেন তিনি। ‘তাঁতই তো নেই। তাহলে সুতা বেচেন কার কাছে?’ ‘সুতা বিক্রি হয় সিরাজদিখানের হাটে। মুন্সিগঞ্জ সদর, সিরাজদিখান, ঢাকার দোহারে কিছু তাঁত এখনো আছে। তারা কিনে নেয়।’ শিশিরের নির্লিপ্ত উত্তর।
রোহিতপুর বাজারে তাঁতিদের সমিতি আছে, কিন্তু কোনো অফিস নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, সমিতির নেতাদেরও এখন কোনো তাঁত নেই। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ী মুসলিমউদ্দিনের দোকানে বসে মুঠোফোনে কথা হলো সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে। এখানে কোনো তাঁত সচল নেই, তাহলে আদি রোহিতপুরি লুঙ্গির উৎস কী? এ প্রশ্নে তাঁর জবাব, ‘অন্যখানে হইতাছে। ...পরতা হয় না। কী করা!’