চিকিৎসক-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ চার মাস

অর্থসংকটে ধুঁকে ধুঁকে চলছে নীলফামারীর সৈয়দপুরের ফাইলেরিয়া হাসপাতাল। বিশেষায়িত এ হাসপাতালে সরকারিভাবে ফাইলেরিয়ার ওষুধ সরবরাহ করায় রোগীরা মোটামুটি সেবা পাচ্ছেন। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চার মাস বেতন বন্ধ রয়েছে। ঈদের আগে বেতন না পেলে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন তাঁরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফাইলেরিয়া বা গোদ একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। ফাইলেরিয়া-সংশ্লিষ্ট কয়েকটি পরজীবী এ রোগের জন্য দায়ী। আক্রান্ত ব্যক্তির হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যায়। অনেকে আস্তে আস্তে পঙ্গুত্ব বরণ করে। কয়েক প্রজাতির মশার মাধ্যমে এসব পরজীবী আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ মানুষে সংক্রমিত হয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইম্যুনোলজি অব বাংলাদেশ (আইএসিআইবি) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ২০০২ সালে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। জাপান সরকার ১০ শয্যার এ হাসপাতালের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সেবার মান বাড়াতে ২০১২ সাল পর্যন্ত জাপান সরকারের পাশাপাশি কানাডা সরকার সহায়তা দিয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারও সহায়তা দেয়। হাসপাতালের জন্য সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকে এটিকে বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে হাসপাতালটি এখন কঠিন সময় পার করছে। সে কথা জানালেন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক সুরত আলী। তিনি বলেন, আর্থিক সংকটের পাশাপাশি ওষুধ এবং জনবলের অভাবে বর্তমানে হাসপাতালটি চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ওষুধ ও চিকিৎসকের অভাবে এখন অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হয়। আবার টাকা না থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের আয়ের অন্যতম উৎস অ্যাম্বুলেন্সটিও মাঝেমধ্যে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকছে। ফলে বহির্বিভাগে আসা রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থই এখন একমাত্র ভরসা।

হাসপাতালের এই সংকট মূলত শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। ওই সময়ে হাসপাতালের দায়িত্ব ছাড়েন চিকিৎসক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি ছিলেন আইএসিআইবি সংস্থার চেয়ারম্যান। ফাইলেরিয়া হাসপাতাল প্রকল্পের প্রধান হিসেবে মোয়াজ্জেমই নানাভাবে চেষ্টা করে জাপান সরকারসহ অন্যদের কাছ থেকে সহায়তা এনেছিলেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে তিনি দায়িত্ব ছাড়েন। বর্তমানে একটি পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে হাসপাতালটি চলছে।

হাসপাতালে বর্তমানে ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসক মাত্র একজন। কিন্তু চার মাস ধরে তাঁরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। কারণ, বর্তমানে হাসপাতালের আয় বলতে বহির্বিভাগে আসা রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া ফি ও একটি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া। সামান্য এই আয় দিয়ে হাসপাতালটি কোনোরকমে চলছে। চিকিৎসক-সংকট থাকায় মাঝেমধ্যে চুক্তিতে চিকিৎসক এনে জরুরি অস্ত্রোপচার করানো হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন নার্স বলেন, ‘আমরা চার মাস ধরে কোনো বেতন পাইনি। দোকানিরাও আর বাকিতে সওদা দিতে চায় না। সামনেই ঈদ। ভাগ্যে কী হবে বলতে পারছি না।’

১১ জুন সরেজমিনে দেখা যায়, সৈয়দপুরের কামারপুকুর ইউনিয়নের ধলাগাছ এলাকায় ৭০ শতাংশ জমির ওপর গড়ে উঠেছে ফাইলেরিয়া হাসপাতাল। বিশেষায়িত এ প্রতিষ্ঠানে দুটি বহুতল ভবন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিলনায়তন, বিশ্রামাগার ইত্যাদি রয়েছে। ফাইলেরিয়া রোগীদের জন্য অস্ত্রোপচার কক্ষসহ অবকাঠামোগত অন্যান্য সুবিধা আছে। ফলে এখানে বহির্বিভাগে সেবা নেওয়ার পাশাপাশি অনেকে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেন।

সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক গৌরাঙ্গ চন্দ্র তাঁর মায়ের জন্য ফাইলেরিয়ার ওষুধ নিতে নিয়মিত এ হাসপাতালে আসেন। কিন্তু ওষুধ না পেয়ে প্রায়ই তাঁকে ফিরে যেতে হয় বলে জানালেন।

হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মকর্তারা বলছেন, নীলফামারী ও রংপুরের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়ায় ফাইলেরিয়ার প্রকোপ দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে নীলফামারীর ২০ শতাংশ মানুষ হয় ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত বা এ রোগের জীবাণু বহন করে বলে সাম্প্রতিক এক জরিপে তথ্য এসেছে। সে ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে এ রোগ ঠেকাতে সৈয়দপুরের ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রায়হান তারেক বলেন, প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৩৫-৪০ জন রোগী আসেন। ইতিমধ্যে এখানে সেবা নিয়ে অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে হাসপাতালটির সেবা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে। হাসপাতালটির সেবা কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে অতি দ্রুত সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।