ইলিশ সবচেয়ে মূল্যবান

উপমহাদেশের ২৬ কোটি লোক ইলিশ খায়, তবে বাংলাদেশেই এই মাছ ধরা পড়ে সবচেয়ে বেশি। এবার ভরা বর্ষার কারণে মধ্য জুলাই থেকেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। ছবিটি সম্প্রতি চট্টগ্রামে মাছের বড় পাইকারি বাজার ফিশারিঘাট থেকে তোলা l জুয়েল শীল
উপমহাদেশের ২৬ কোটি লোক ইলিশ খায়, তবে বাংলাদেশেই এই মাছ ধরা পড়ে সবচেয়ে বেশি। এবার ভরা বর্ষার কারণে মধ্য জুলাই থেকেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। ছবিটি সম্প্রতি চট্টগ্রামে মাছের বড় পাইকারি বাজার ফিশারিঘাট থেকে তোলা l জুয়েল শীল

বর্ষা এলেই বাঙালি ইলিশের স্বাদ পেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এবার জুলাই থেকেই বঙ্গোপসাগর বেয়ে বাংলার নদ-নদীতে ইলিশ আসতে শুরু করেছে। চকচকে রুপালি এই মাছ এবার ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর, যার আর্থিক মূল্য হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ইলিশের বাজারমূল্যই সবটা নয়, আরও অনেক বিষয়ের গুরুত্বের কথাও এখন আলোচনায় আসছে। এগুলোকে বলা হচ্ছে খাদ্যবহির্ভূত মূল্য (নন-কনজাম্পটিভ ভ্যালু)।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি), বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ যৌথভাবে ইলিশের খাদ্যবহির্ভূত মূল্য নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে করা ওই গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্য ছাড়াও ইলিশের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জীবিকা সৃষ্টির মূল্য রয়েছে। একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইলিশের এই চারটি বিষয়ের আর্থিক মূল্যমান পরিমাপ করেছে তারা। তাতে এর খাদ্যবহির্ভূত গুরুত্বের মূল্যমান দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এই আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থাগুলো বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে ইলিশ। ভারতে কই মাছের বাজার বা মোট আর্থিক মূল্য সবচেয়ে বেশি হলেও তার বড় অংশ আসে কৃত্রিমভাবে চাষ থেকে। প্রাকৃতিক উৎসের মাছের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইলিশ। শুধু আর্থিক বা খাবার মূল্য নয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও জীবনযাত্রার দিক থেকেও ইলিশ এই উপমহাদেশের সেরা মাছ।
এ ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকোফিশ প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব প্রথম আলোকে বলেন, শুধু স্বাদ ও পুষ্টিমূল্য নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাছ হচ্ছে ইলিশ। কোনো একটি প্রকৃতিনির্ভর মাছের ওপর এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকা নির্ভর করার বিষয়টিও বিরল। সব দিক থেকে বলা যায়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান মাছ।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১০ শতাংশ এবং দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। ভিয়েতনাম থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি থাকলেও বাংলাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে (৫০-৬০ শতাংশ)। পাশাপাশি মিয়ানমারে ২০-২৫ শতাংশ, ভারতে ১৫-২০ শতাংশ এবং অন্য কয়েকটি দেশেও ৫-১০ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে।
ইলিশের দাম
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর দেশে ধরা পড়া ইলিশের পরিমাণ, আয়তন ও ওজন বেড়েছে। ফলে ইলিশের দামও গত এক বছরে কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। একসময় যে ইলিশ হয়ে গিয়েছিল উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনীদের আহার, তা গত বছর থেকে মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমায় চলে আসে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ১ লাখ টন বেড়ে ৫ লাখ টন হয়েছিল।
তবে ইলিশের এই উৎপাদন বৃদ্ধি টেকসই হবে কি না, তা নিয়ে ওই তিন সংস্থার গবেষণায় কিছুটা সংশয় তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলছে, ইলিশ ধরেন যে জেলেরা, তাঁরা এখনো দাদন ব্যবসায়ী ও নৌকার মালিকদের হাতে জিম্মি। বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবেই জেলেদের জালে ধরা পড়া মাছের ৮০ শতাংশ চলে যায় দাদন ব্যবসায়ী ও নৌকার মালিকের হাতে। জেলেরা পান বাকি ২০ শতাংশ। জেলেদের স্বল্প সুদে ও শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল জেলেদের পাতেও যাবে বলে ওই গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফ আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সহায়তায় ইলিশ আহরণকারী জেলেদের জন্য সাড়ে ৩ কোটি টাকার একটি তহবিল তৈরি করেছি। তা থেকে ইলিশ ধরার মৌসুমে জেলেদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। এতে জেলেদের আর্থসামাজিক অবস্থার আরও উন্নতি হবে।’
আইআইইডি, ওয়ার্ল্ড ফিশ ও বিসিএএসের ওই যৌথ গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষভাবে ইলিশ আহরণের ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি আরও ২৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে ইলিশ প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত।
ইলিশের সাংস্কৃতিক মূল্য
সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের কাছে ইলিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ওডিশা, বিহার ও আসামেও বাংলা সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে ইলিশের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পয়লা বৈশাখ, জামাইষষ্ঠী ও পূজায় ইলিশের ব্যবহার হয় নিয়মিত।
গবেষণায় বলা হয়েছে, একসময় দেশের প্রায় এক শ নদীতে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত। জেলেরা বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরে স্থানীয় ও শহরের বাজারে বিক্রি করতেন। স্বাধীনতার পর ৩০ বছরে ইলিশ মাছের উৎপাদন ২০০১-০২ সালে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছিল। সে বছর দেশের নদীগুলোতে ১ লাখ ৯০ হাজার টন ইলিশ পাওয়া যায়। ইঞ্জিনচালিত বড় নৌযান চলাচল বন্ধ না হওয়া, নদীতে পলি জমা, মাত্রাতিরিক্ত মাছ আহরণ, নির্বিচার মা-মাছ ও জাটকা নিধন, খুব ছোট ছিদ্রের জাল ব্যবহার, মাছ ধরায় যান্ত্রিকীকরণ ও জেলেদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ বলে ধারণা করেন জেলেরা। উৎপাদনের এই অস্বাভাবিক পতনে ইলিশের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। এ জন্য স্বল্প আয়ের লোকজন ইলিশ কেনা থেকে বঞ্চিত হয়।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, বর্তমানে দেশের ২৫টি নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। একসময় পদ্মার ইলিশ ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। সবচেয়ে বেশি ইলিশ সেখানেই পাওয়া যেত। বর্তমানে মেঘনা অববাহিকার ২০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সবচেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। এর বাইরে তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ, পদ্মা, পায়রায় বেশি ইলিশ পাওয়া যায়।
২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ বিশেষজ্ঞ ড. আনিসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মাঝখানে ইলিশ মাছ দেশের ১০-১২টি নদীতে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে ২০ থেকে ২৫টি নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। বর্ষাকালে এখন অনেক নতুন নতুন নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
গবেষণায় বরিশাল বিভাগের পাঁচটি জেলায় (বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি) ১ হাজার ৬টি মৎস্যজীবী ও অমৎস্যজীবী পরিবারের কাছে ইলিশের জন্য প্রধান হুমকিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে মোট চারটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো নদী পুনঃখনন, পানিদূষণ রোধ, প্রজনন ঋতুতে নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরা থেকে বিরত থাকা জেলেদের ক্ষতিপূরণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা এবং ক্ষতিকর উপকরণ (যেমন কারেন্ট জাল) পরিহার করা। এ রকম একটি কর্মসূচির জন্য প্রচুর আর্থিক জোগান প্রয়োজন।
এই মৎস্যসম্পদকে পুনরুদ্ধারের জন্য বিনিয়োগ খুবই অপ্রতুল এবং এর ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীদের জীবনধারণই অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইলিশ সম্পদের ক্রমাগত এ নিম্নমুখী ধারাকে ঊর্ধ্বমুখী করে সত্তরের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ব্যাপক বিনিয়োগ প্রয়োজন। পদক্ষেপ নেওয়া হলে দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীতে আবার ইলিশের প্রাচুর্য দেখা দেবে, একেকটি ইলিশের ওজন হবে ৩০০-৮০০ গ্রাম পর্যন্ত এবং অধিকাংশ মানুষ ইলিশ কেনার সামর্থ্য অর্জন করবে। নদী পুনঃখনন ও দূষণ রোধ করতে হবে এবং প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরতে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলেদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মৎস্য আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ ব্যাপারে আইআইইডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মোহাম্মদ এসাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা খুবই কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত। তবে এই অর্জনকে টেকসই করতে হলে বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদন এলাকার ওপর নিয়মিত সমীক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
পুষ্টিমানেও এগিয়ে
ওয়ার্ল্ড ফিশের পক্ষ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ৩০টি জনপ্রিয় মাছের পুষ্টিগুণ নিয়ে ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে পুষ্টিকর মাছ হচ্ছে ইলিশ। ইলিশের পুষ্টিগুণের বিস্তারিত হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে ১ হাজার ২০ কিলো জুল (শক্তির একক) শক্তি থাকে। তাতে ১৮ থেকে ২২ গ্রাম চর্বি, ২২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১৪ দশমিক ৪ গ্রাম প্রোটিন, ২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম আয়রন, সামগ্রিক ফ্যাটি অ্যাসিডের ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ ওমেগা-৩ থাকে।
শুধু দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার প্রায় ২৬ কোটি মানুষ ইলিশ মাছ খায়। স্যামন ও টুনার পরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে জনপ্রিয় মাছ হচ্ছে ইলিশ। ওয়ার্ল্ড ফিশের হিসাবে ওমেগা-৩ পুষ্টিগুণের দিক থেকে স্যামন মাছের পরেই ইলিশের অবস্থান।
বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ইলিশের পুষ্টিগুণের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ইলিশ মাছে ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম। অন্যদিকে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে। ফলে হৃদ্যন্ত্র থাকে সুস্থ। ইলিশ মাছ খেলে শরীরে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়। থ্রম্বসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। এ ছাড়া ভিটামিন এ ও ডি-র উত্কৃষ্ট উত্স ইলিশ।