৫ কোটি মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে ওআরএস

আমেনা বেগম রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায় ছয়টি বাড়িতে ঠিকা বুয়ার কাজ করেন। মাঝেমধ্যেই এলাকার রফিকের মুদি দোকান ও রাস্তার উল্টো দিকের ফার্মেসি থেকে খাওয়ার স্যালাইন (ওআরএস) কেনেন। স্যালাইন খান কেন, কে খেতে বলেছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে আমেনা বলেন, ‘এ্যামনেই খাই। শোরিলটা দুর্বল লাগলে খাই। কেউ খাইতে বলে নাই। খাইলে ভাল্‌ লাগে।’

মুদি দোকানি রফিক বলেন, ‘এলাকার বেবাগ মানুষ স্যালাইন খায়। সদাইপাতির সঙ্গে স্যালাইনও রাখছি। ভাই, গরমে ব্যাপক চাহিদা।’ স্যালাইন আপনার দোকানে কে দিয়ে যায়? উত্তরে রফিক বলেন, ‘কারওয়ান বাজারের পাইকারি মার্কেট থেকে কিনে আনি।’
শুধু রফিকের মুদি দোকানে নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকার অধিকাংশ মুদি দোকানে বিভিন্ন কোম্পানির খাওয়ার স্যালাইন বিক্রি হয়। ওষুধের দোকান বা ফার্মেসিতে বিক্রি তো হয়ই।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া অর্থাৎ বাংলাদেশের সব জায়গায় খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া যায়। প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট মুদি বা ওষুধের দোকানেও এর প্যাকেট বিক্রি হয়। কিনতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের দরকার হয় না। এমনকি মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শেরও প্রয়োজন বোধ করছে না। ডায়রিয়া দেখা দিলে ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব, শিক্ষিত, নিরক্ষর—সবাই ওআরএসের প্যাকেট কিনে পানিতে মিশিয়ে খেয়ে নিচ্ছেন, শিশুকে খাওয়াচ্ছেন। এতে ডায়রিয়া ভালো হয়। গরমে ঘাম ঝরলে বা কায়িক পরিশ্রমের পর অনেকেই নিয়মিত ওআরএস খান। ‘খাইলে ভাল্‌ লাগে’। অনেকের বাড়িতে অন্য অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সঙ্গে ওআরএসের প্যাকেট মজুত থাকে। ভ্রমণে বা দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে সঙ্গে ওআরএসের প্যাকেট নিতে দেখা যায়।

টাইম সাময়িকীর ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
টাইম সাময়িকীর ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির (এসএমসি) জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (ওটিসি পণ্য) শায়লা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিন দিন মুখে খাওয়ার স্যালাইনের (ওরাল রিহাইড্রেশন সলুশ্যান-ওআরএস) ব্যবহার বাড়ছে। শুধু ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, শরীরে পানিশূন্যতা বোধ করলেই মানুষ স্যালাইন খায়। গরমের দিনে স্যালাইন খাওয়া এখন অনেকের অভ্যাস।’
ওষুধ কোম্পানিগুলোর দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী, গত অর্থবছরে (২০১৬ জুলাই-২০১৭ জুন) দেশে প্রায় ১১০ কোটি ওআরএসের প্যাকেট বিক্রি হয়েছে। শায়লা পারভীন বলেন, ‘এসএমসির প্রাক্কলন ছিল ৬৬ কোটি ২০ লাখ প্যাকেট বিক্রি করার। কিন্তু আমরা বিক্রি করেছি ৬৯ কোটি ৭০ লাখ প্যাকেট। অর্থাৎ আমাদের প্রাক্কলনের চেয়ে সাড়ে তিন কোটি প্যাকেট বেশি বিক্রি হয়েছে।’ আগের বছরের তুলনায় বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪ শতাংশ। শায়লা পারভীন বলেন, গত কয়েক বছরে এ রকমই বৃদ্ধি হচ্ছে সব কোম্পানির।
এসএমসি ১৯৮৫ সাল থেকে ওআরএস বাজারজাত করছে। প্রতিষ্ঠানটির কাগজপত্রে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে ওআরএস এ পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী ১২ লাখ শিশুর জীবন রক্ষা করেছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ওআরএস বিশ্বব্যাপী পাঁচ কোটি শিশুর জীবন রক্ষা করেছে।
এক প্যাকেট স্যালাইন আধা লিটার পানিতে গুলে খেতে হয়। এতে শরীরের পানিশূন্যতা দূর হয়। ডায়রিয়া হলে পরিমাণ মতো বারবার খেতে হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া না গেলে, আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে এক মুঠ চিনি বা গুড় এবং এক চিমটি লবণ গুলে খেলে একই কাজ হয়। সহজ এই প্রযুক্তি এখন বিশ্বব্যাপী ডায়রিয়া চিকিৎসার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
ওআরএস এল কোথা থেকে
বিশ্বব্যাপী কোটি মানুষের জীবন রক্ষাকারী এই ওআরএস নিয়ে গবেষণা, এর আবিষ্কার, মানুষের কাছে পৌঁছানোর কৌশল, মানুষকে ওআরএস বানাতে শেখানো—এর সবকিছুই হয়েছে বাংলাদেশে। মূল গবেষণা করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা। আইসিডিডিআরবির সাবেক পরিচালক কে এম এস আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু আইসিডিডিআরবি নয়, পুরো বাংলাদেশই ছিল ওআরএসের গবেষণাগার। এখন পুরো বিশ্ব এর সুফল পাচ্ছে।’
গত শতকের ষাটের দশকে কলেরা গবেষণার জন্য রাজধানীর মহাখালীতে কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি (বর্তমানে আইসিডিডিআরবি) স্থাপন করা হয়। কলেরার কারণ, প্রাদুর্ভাব বুঝতে বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা এখানে কাজ শুরু করেন। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশি গবেষকেরা।
আইসিডিডিআরবি সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ১৯৬৪ সালে ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল মেডিকেল রিসার্চ ইউনিট গ্লুকোজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও বাই কার্বোনেট ব্যবহার করে কলেরা রোগীর ওপর একটি গবেষণা করে। তবে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় ও কলকাতায় বয়স্ক কলেরা রোগীদের গ্লুকোজ খাইয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। একই সময়ে চট্টগ্রামে মাঠপর্যায়ে একটি গবেষণা হয়েছিল, তবে পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকার কারণে চট্টগ্রামের ওই গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।
এরপর মাঠপর্যায়ে ওআরএসের কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় মতলবে ও ঢাকায়। এর মূল গবেষক ছিলেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ডেভিড আর নেলিন ও রিচার্ড এ ক্যাস। অনেকে এই দুই বিজ্ঞানীকে ওআরএসের উদ্ভাবক বলে মনে করেন। ওই গবেষণার সঙ্গে রিসার্চ ফেলো হিসেবে যুক্ত ছিলেন একই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি বিজ্ঞানী রফিকুল ইসলাম ও মজিদ মোল্লা। ওই গবেষণার ফলাফল ১৯৬৮ সালের আগস্টে ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, কলেরা রোগীদের গ্লুকোজ, সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম বাই কার্বোনেট ও পটাশিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণ খাওয়ানো হয়। ভালো ফল পাওয়া যায়। ওই গবেষণা প্রবন্ধের শেষ দিকে বলা হয়, এই খাওয়ার দ্রবণের উপাদানগুলো সস্তা ও সহজ প্রাপ্য। পানযোগ্য পানি দিয়ে এই দ্রবণ তৈরি করা যায়। উপাদানগুলো মজুত করা সম্ভব। এরপর থেকে আইসিডিডিআরবির মহাখালীর কলেরা হাসপাতালে ডায়রিয়ায় পানিশূন্যতা দূর করতে ওআরএস ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শরণার্থীশিবিরে বিপুল পরিমাণে ওআরএস ব্যবহার করা হয়েছিল। এ নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ আছে।
আইসিডিডিআরবির একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সাবেক একাধিক বিজ্ঞানী প্রথম আলোকে বলেছেন, ওআরএস আবিষ্কার একক কোনো বিজ্ঞানীর কৃতিত্বে সম্ভব হয়নি। এটা অনেকটা রিলে রেসের মতো। ওআরএসের গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা তৈরি হওয়ার আগে অনেকে অনেক ধরনের কাজ করেছেন। চূড়ান্ত রূপটা এসেছে ১৯৬৭/৬৮ সালে।
যেমন তরল পদার্থ খাইয়ে কলেরা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, তার গবেষণা কলকাতায় শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট ১৯৫৩ সালে ২১ নভেম্বর সংখ্যায় ওই গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করে। কলকাতার চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের কলেরা ওয়ার্ডের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক হেমেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জির লেখা প্রবন্ধে দেখা যায়, ১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালে কলেরায় আক্রান্ত কিছু রোগীর বমি ও পানিশূন্যতা দূর করার জন্য অ্যাভোমিন ট্যাবলেটের সঙ্গে পাথরকুচি পাতার রস খাওয়ানো হয়েছিল এবং তাতে ফলও পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদক হেমেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জির ওই গবেষণার উল্লেখ অন্য আর কোথাও পাননি। আইসিডিডিআরবির বর্তমান ও সাবেক বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
আইসিডিডিআরবির নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তাহমিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুষ্ট, শিশুস্বাস্থ্য বা ডায়রিয়াজনিত রোগবিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিতে পৃথিবীর যে প্রান্তে যাই, সবখানেই ওআরএস নিয়ে আলোচনা হয়। অবধারিতভাবে আইসিডিডিআরবি ও বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়। গর্বে বুক ভোরে যায়।’
আইসিডিডিআরবি ওআরএস তৈরির ফর্মুলা পেটেন্ট করেনি। যে কেউ এটা তৈরি করতে পারে। এ নিয়ে সামান্য হলেও কারও কারও মধ্যে হতাশা আছে। আইসিডিডিআরবির ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আইসিডিডিআরবির গবেষণা ও প্রশাসনিক কাজে জড়িত ছিলেন। প্রবীণ এই বিজ্ঞানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওআরএস পেটেন্ট করা হয়নি, পেটেন্ট করার চিন্তাই করা হয়নি। আমরা ট্রেন ধরতে পারিনি (উই মিসড্‌ দ্য ট্রেন)।’
শতাব্দীর সেরা অগ্রগতি
জীবনরক্ষার সম্ভাবনা অনুধাবন করে ল্যানসেট ১৯৭৮ সালের ৫ আগস্টের সম্পাদকীয়তে বলেছিল, ওআরএসের আবিষ্কার চিকিৎসার ক্ষেত্রে শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এটি তীব্র ডায়রিয়া চিকিৎসায় মুখে তরল খাওয়ানোর রাস্তা খুলে দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ডায়রিয়া।
যখন মেডিকেল গবেষণার মাধ্যমে জীবনরক্ষাকারী নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি আসে, তখন তা সাধারণত জটিল ও ব্যয়বহুল হয় এবং অনেকের কাছে তা দুষ্প্রাপ্য থেকে যায়। কিন্তু মুখে তরল খাওয়ানোর মাধ্যমে চিকিৎসা বা ওআরএস এর ব্যতিক্রম। ওআরএস জটিল না, সস্তা এবং যে কেউ এটা পেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর কোনো শিশু বা বয়স্ক ডায়রিয়ায় মারা যাবে না, যদি ওই ব্যক্তির পরিবার মুখে খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করতে জানে বা পরিবারে ওআরএসের প্যাকেট মজুত থাকে।
আইসিডিডিআরবির ক্লিনিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী নুর হক আলম আশির দশক থেকে ওআরএস নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওআরএসের গুণগত মান বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ওআরএস তৈরির গবেষণা আইসিডিডিআরবিতে শুরু থেকেই হয়ে আসছে। এখনো সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ‘রাইস স্যালাইন’-এর উদ্ভাবন এর মধ্যে অন্যতম অগ্রগতি।’
এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি
আশির দশকে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারকে খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করতে শেখানোর কাজটি করেছিল ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা। ব্র্যাকের ভাইস চেয়ার মোস্তাক রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজটি সহজ ছিল না। ব্যাপক প্রস্তুতি ও সঠিক পরিকল্পনার কারণে মানুষকে সচেতন করা সম্ভব হয়েছিল।’
ডায়রিয়ার প্রকোপ ছিল সারা দেশেই। সারা দেশের মানুষের কাছে স্যালাইনের প্যাকেট পৌঁছানো ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই মানুষকে যদি স্যালাইন তৈরি করতে শেখানো যায়, তা হলে সমস্যার সমাধান হতে পারে—এ রকম ধারণা থেকে ‘এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি’ ফর্মুলা নিয়ে মাঠে নামে ব্র্যাক। মোস্তাক চৌধুরী বলেন, ‘এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি’ কার্যকর বলে বিজ্ঞানীরা মেনে নেন। আর মানুষকে শেখানোর জন্য সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় একটি দিশারি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ব্র্যাক। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শেখানো হয়: প্রথমে পানি ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। একটি পাত্রে আধা সের (আধা লিটারের কিছু বেশি) পানি নিয়ে তাতে এক চিমটি লবণ ও এক মুঠ গুড় নিয়ে ভালো করে গুলতে বা ঘুটতে হবে। তারপর সেই দ্রবণ ডায়রিয়ার রোগীকে খাওয়াতে হবে। ওই প্রকল্প সফল হওয়ার পর সারা দেশে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় ব্র্যাক। এ ক্ষেত্রে ব্র্যাককে সব ধরনের সহায়তা দেয় সরকার।
গ্রামের মানুষকে ডায়রিয়া সম্পর্কে সচেতন করা ও বাড়িতে স্যালাইন তৈরি করার প্রকল্প ব্র্যাক শুরু করেছিল ১৯৮০ সালে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গ্রামের মাঠকর্মীরা প্রতিটি খানার অন্তত একজন সদস্যকে পানি, লবণ ও গুড়ের দ্রবণ তৈরি করা শেখান। সরকারি গণমাধ্যম বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন এ ব্যাপারে নিয়মিত প্রচার চালায়। মোস্তাক চৌধুরী বলেন, ‘১৯৯০ সাল নাগাদ আমরা দেশের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছিলাম।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্র্যাকের এই কর্মসূচি ডায়ারিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। সাধারণ মানুষ স্যালাইন তৈরি করতে পারে। আর ডায়রিয়া হলে স্যালাইন খেতে হয়, সেই সচেতনতাও মানুষের এসেছে। আজ দেশব্যাপী লাখ লাখ ওআরএসের প্যাকেট বিক্রি হওয়ার কারণও এই জনসচেতনতা।
এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি, স্যালাইন তৈরিতে এই ফর্মূলার সাফল্য নিয়ে টাইম সাময়িকী ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপে।

ছড়াল বিশ্বব্যাপী
১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পরে ইউনিসেফ ওআরএসের ব্যবহার বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হয়। তখন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানবিষয়ক পরিচালক ছিলেন কে এম এস আজিজ। অধ্যাপক আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক সমাজের কাছে ওআরএস গ্রহণযোগ্য করে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সরকার তখন একটি জাতীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সেই প্রকল্পের আওতায় আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগী ব্যবস্থাপনা ও ওআরএস ব্যবহারের ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়। প্রতি সপ্তাহে ২০ জন করে সরকারি চিকিৎসককে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
এরপর আইসিডিডিআরবিতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়। অধ্যাপক আজিজ বলেন, প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএনডিপিও আগ্রহ দেখায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরবর্তী সময়ে ডিডিসি (ডায়রিয়াল ডিজিজ কন্ট্রোল) কর্মসূচি হাতে নেয়। ওই কর্মসূচির আওতায় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ডায়রিয়ার ব্যবস্থাপনা ও ওআরএসের ব্যবহার নিয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এসব প্রশিক্ষণে যুক্ত ছিলেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও প্রশিক্ষকেরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ ডায়রিয়া। প্রতি বছর ৫ লাখ ২৫ হাজার শিশুর এতে মৃত্যু হচ্ছে। ডায়রিয়া হলে পায়খানার সঙ্গে পানি দ্রুত বের হয়ে যায়। ওআরএসের মাধ্যমে সেই পানি প্রতিস্থাপন করা হয়। ওআরএসের মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।