'হাতির মতো' পা নিয়ে হাসপাতালে রিজিয়া

রিজিয়া বেগম চিশতি
রিজিয়া বেগম চিশতি

রিজিয়া বেগম চিশতি নিজের শাড়ি দিয়ে বিশাল আকৃতির ডান পা-টি ঢেকে রাখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বেঢপ আকার ধারণ করা পা-টির বেশ খানিকটা অংশ বের হয়ে যাচ্ছিল।
রিজিয়া বেগম বললেন, কেউ কেউ বলে তাঁর এ পায়ের ওজন নাকি ৬০ কেজির বেশি হবে। আর যত দিন যাচ্ছে, পায়ের ওজন বাড়ছেই, তা বহন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

রিজিয়া বেগম ভর্তি হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। আজ বৃহস্পতিবার কথা হয় তাঁর সঙ্গে। নিজের পা-টা একটু নাড়াচাড়া করতে চাইলেও অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। যিনি সাহায্য করতে আসেন, তিনি নিজেও হাঁপিয়ে ওঠেন। গত আড়াই-তিন বছর ধরে রিজিয়া এভাবেই চলছেন। চলা বলতে, বিছানায় পাথরের মতো বসে থাকা। কেউ যদি খাবার এগিয়ে দেন তবে খেতে পারেন।

বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অস্বাভাবিক পা ফুলে যাওয়ার রোগটি ‘এলিফ্যান্টিয়াসিস’ নামে পরিচিত। পা ফুলে অনেকটা হাতির পায়ের মতো হয়ে যায় বলে এ রোগের নামকরণ হয়েছে ‘এলিফ্যান্টিয়াসিস’।

সিলেটের ওসমানীনগর থানায় বাড়ি রিজিয়ার। এক ছেলে মারা গেছে। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে এইচএসসিতে পড়ছে। তিন ছেলেমেয়ের জন্মের পর থেকেই রিজিয়া বেগমের পায়ে নানান সমস্যা দেখা দিতে থাকে। তবে শুরুতে সমস্যা তেমন প্রকট হয়নি। সমস্যা শুরু হয়েছে সেও তো প্রায় ১৫ বা ১৬ বছর আগের কথা। আর পা পুরোপুরি ফুলে বর্তমান আকার ধারণ করেছে গত আড়াই থেকে তিন বছর ধরে।
রিজিয়া বেগমের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর স্বামী আবদুল মানিক। দুজনই মাথা নেড়ে জানালেন, বলতে গেলে তাঁরা সেভাবে সংসার করতেই পারলেন না। কৃষিকাজ করে সংসার চালানো মানিক জানালেন, স্ত্রীকে এ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য অনেক জায়গায় নিয়ে গেছেন। সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা করেছেন দীর্ঘদিন। মানিক অভিযোগ করে জানালেন, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘সিট খালি হলে’ ভর্তি করা হবে বলে বলছে গত দেড় বছর ধরে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়েছে। বার্ন ইউনিটে রিজিয়া বেগমের চিকিৎসার বিভিন্ন কাগজপত্র দেখে চিকিৎসকেরা এখানে ভর্তি করতে বলেছেন, পরে এখানে আনা হয়েছে।

রিজিয়া বেগম বলেন, সিলেট থেকে ১০ হাজার টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় আসতে হয়েছে। এখানে ভর্তি হওয়ার পর কিছু দামি পরীক্ষা বাইরে থেকে করতে বলা হয়েছে। আবারও অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হবে। তিনি বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সে যাইতে হইব। ট্যাকা পামু কই?’

মানিক স্ত্রীর চিকিৎসা প্রসঙ্গে বললেন, ‘যত দিন বাঁইচ্যা আছে কী আর করমু? মাথায় বাড়ি মাইরা তো আর পারতে পারমু না।’

স্ত্রীর চিকিৎসার পেছনে খরচ করতে গিয়ে নিজের বাড়ি-ঘর বেঁচেছেন মানিক। এখন অন্যের জায়গায় থাকেন। মানিক জানালেন, চিকিৎসার নামে কবিরাজ-ওঝা মিলেই তো অনেক টাকা নিয়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘যে যেটা কইছে, কোনোটা বাদ দেই নাই। কত কিছু করলাম। এলাকার লোকজন এখন সবুর করতে বলে।’

রিজিয়া বলছে, স্বামী ভালো বলেই এখন পর্যন্ত তিনি তাঁর সঙ্গে আছেন। মুখ কালো না করে সেবাযত্ন করেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, খালি পায়ের ওজন বাড়ছেই। এখন বিছানায় বসে থাকা ছাড়া তো তাঁর আর কোনো গতি নেই। এভাবে আর কত দিন বাঁচা যায়?

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিজিয়া বেগমের রোগটি বিরল রোগ নয়। চিকিৎসায় এ অসুখ ভালো হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে। কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করতে হবে।’