তিন মেয়ের তিন কষ্ট

মুক্তামণি, জেবা তাসনিয়া আর মোসকান আক্তার সোমা—তিন রকমের কষ্ট নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে দিন পার করছে। এই তিন শিশু নিজেদের কষ্ট ভালোভাবেই বুঝতে পারছে, তাই তারা ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায়। তাদের মতো কষ্ট পাওয়া শিশুদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা করতে চায় বলে ওরা প্রথম আলোকে জানিয়েছে।

গতকাল বুধবার দুপুরের দিকে বার্ন ইউনিটে এই তিন শিশুর সঙ্গে কথা হয়। গণমাধ্যমের কল্যাণে সাতক্ষীরার মুক্তামণি এখন সবার পরিচিত। রক্তনালির টিউমারে সে আক্রান্ত। ওর ডান হাত বেঢপ আকার ধারণ করেছিল। অস্ত্রোপচার করে হাতের টিউমার অপসারণ করেছেন চিকিৎসকেরা। শরীরের অন্য জায়গা থেকে চামড়া এনে তা অস্ত্রোপচার করা হাতে লাগানোর অপেক্ষায় আছে সে।

সাতক্ষীরার আরেক শিশু জেবা তাসনিয়া। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে সে। ওর মুখের এক পাশ জন্ম থেকেই ফোলা ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ফোলাও তত বড় হচ্ছে। ফোলার জন্য এখন সারাক্ষণ এক চোখ প্রায় বন্ধ করে রাখতে হয়। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জের মোসকান আক্তার সোমা অস্বাভাবিক একটি হাত নিয়ে জন্ম নিয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া সোমার হাতের মতো বুক ও শরীরের বিভিন্ন জায়গাও অদ্ভুতভাবে ফুলে যাচ্ছে।

মুক্তামণি।
মুক্তামণি।

বার্ন ইউনিটের কেবিনে আছে মুক্তামণি। কেবিনে গিয়ে দেখা গেল, মুক্তামণি একটি মুঠোফোনের স্ক্রিনে কার্টুন ছবি দেখছে। ডান হাতে মোটা ব্যান্ডেজ আর বাঁ হাতে রক্ত দেওয়ার জন্য ক্যানোলা লাগানো। তাই মুঠোফোনে গেমস খেলতে পারছে না। মুক্তামণি জানাল, তার বাবার এক বন্ধু বিদেশ থেকে তার জন্য মুঠোফোনটি পাঠিয়েছেন।

প্রতিবেদককে দেখে মুক্তামণি প্রথমেই জানতে চায়, চিকিৎসকেরা তার ব্যাপারে কোনো কিছু বলেছে কি না। একটু হেসে বলে, তাড়াতাড়ি হাতে চামড়া লাগানো শেষ হলে একটু বাড়ি যেতে পারত। কত দিন হলো বাড়ি যায় না।

শরীর কেমন আছে, তা জানতে চাইলে বলে, ‘হাতে খালি ব্যান্ডেজ আর ব্যান্ডেজ। বুঝি না কেমন আছি।’ মুক্তামণির যমজ বোন হীরামণি চোখের সামনে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ায়, মুক্তামণি বিছানায় শুয়ে শুয়ে তা শুধু দেখে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ জানান, গত মঙ্গলবার মুক্তামণির হাতে ড্রেসিং করা হয়েছে। ও এখন ভালো আছে।

শরীরের অন্য জায়গা থেকে চামড়া এনে হাতে লাগানোর জন্য মুক্তামণি চিকিৎসকদের কথা অনুযায়ী দিনে চারটি ডিম খাচ্ছে। অন্যান্য খাবারও খাচ্ছে। নিজেই বলল, ‘আমার তো আর কোনো উপায় নেই।’ বর্তমানে মুক্তামণির চোখেও একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে।

সাতক্ষীরায় জন্মের দেড় বছর বয়স থেকে মুক্তামণির ডান হাতের সমস্যার শুরু। প্রথমে হাতে টিউমারের মতো হয়। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত টিউমারটি তেমন বড় হয়নি। কিন্তু পরে তার ডান হাতটি ফুলে অনেকটা কোলবালিশের মতো হয়ে যায়। সে বিছানাবন্দী হয়ে পড়ে। মুক্তামণির রোগ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। গত ১১ জুলাই মুক্তামণিকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তামণির চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। গত প্রায় আড়াই মাস ধরে হাসপাতালে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে গেছে মুক্তামণি।

জেবা তাসনিয়া
জেবা তাসনিয়া

মুক্তামণি বিছানাবন্দী থাকলেও তাসনিয়া ও সোমা হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারে। সাতক্ষীরায় তাসনিয়ার স্কুলের বন্ধুরা অনেক সময় তাসনিয়াকে বলে, সে নাকি হনুমানের মতো দেখতে। তাসনিয়া এক গাল দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘এখন আর আমি এসব কথায় মাইন্ড করি না।’

তাসনিয়ার ছবি তুলতে চাইলে বলল, দাঁড়ান, মাথাটা আগে আঁচড়াই। বলে মাথার চুলগুলোকে বিশেষ কায়দায় মাথার পাশ দিয়ে নিল, যাতে করে মুখের ফোলা ভাব কিছুটা কম দেখা যায়। তাসনিয়া চলতি বছরে আবৃত্তিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের হাত থেকে সে এ পুরস্কার নিয়েছে। মন্ত্রী নিজে তার চিকিৎসার জন্য বার্ন ইউনিটে পাঠিয়েছেন বলে তাসনিয়া জানাল। তাসনিয়া নিজেই জানিয়ে দিল সে গান, নাচ, একক অভিনয় পারে। পারে ছবিও আঁকতে। এসব শেখানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান তার বাবা।

তাসনিয়ার বাবা হাসান হাফিজুর রহমান কলেজের লাইব্রেরিয়ান আর মা নাসিমা খাতুন হাইস্কুলের শিক্ষক। তাসনিয়ার একমাত্র ভাইয়ের বয়স মাত্র চার বছর। তাই তাঁরা হাসপাতালে থাকতে পারেন না। গত প্রায় দেড় মাস ধরে (ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল) তাসনিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে থাকছেন তার চাচি নাজমা রহমান। তাসনিয়া মুখে অস্ত্রোপচার হওয়ার অপেক্ষায় আছে।

তাসনিয়া ‘২১’ নিয়ে যখন কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিল, তখন বার্ন ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডের অন্য অভিভাবকেরা তার বিছানার পাশে এসে একে একে এসে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন।

বার্ন ইউনিটের জাতীয় সমন্বয়ক চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, তাসনিয়ার সমস্যাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘নিউরোফাইব্রোমা’ বলা হয়। এটি বিরল কোনো সমস্যা নয়। কয়েক ধাপে অস্ত্রোপচার করতে হবে। তবে অস্ত্রোপচারের পরেও এ সমস্যা আবার দেখা দিতে পারে।

মোসকান আক্তার সোমা
মোসকান আক্তার সোমা

মোসকান আক্তার সোমাও বার্ন ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি। তাসনিয়ার সঙ্গে এর মধ্যেই তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এর আগে রাজধানীর অন্য একটি হাসপাতালে সোমার ছোট শরীরে দুটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে গত চার বছর তার সব ধরনের চিকিৎসা বন্ধ ছিল। গণমাধ্যমে মুক্তামণির খবর শুনে বার্ন ইউনিটে গত দুই মাস আগে তাকে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানালেন সোমার দাদি হালিমা বেগম।

সোমার বাবা সৌদি আরব থাকেন। অসুস্থ বলে তেমন একটা কাজ করতে পারেন না। তিনি আরেক বিয়ে করেছেন। পারিবারিক ঝামেলার জন্য চার বছর আগে সোমার মা সোমা এবং তার ভাইকে রেখে বাবার বাড়ি চলে গেছেন। সোমার ভাইয়ের বয়স বর্তমানে ১১ বছর।

হাসপাতালের বিছানায় সোমার দিন কাটে প্রথম শ্রেণির বিভিন্ন বই পড়ে। বাঁ হাতে লেখে। তার স্কুলের শিক্ষকেরা হাসপাতালে এসে নিয়মিত খোঁজখবর নেন বলে জানালেন হালিমা বেগম।

বার্ন ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক লুৎফর কাদের লেনিনের অধীনে ভর্তি আছে সোমা। এই চিকিৎসক জানালেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সোমার সমস্যাটিকে বলা হচ্ছে ‘ভাসকিউলার মেলফরমেশন’। এই চিকিৎসক জানালেন, সোমার হাতে অস্ত্রোপচার করা হলেও হাত দিয়ে সে তেমন কিছুই করতে পারবে না। মেয়েশিশু, তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অস্ত্রোপচারের মধ্যমে হাত ও আঙুলগুলোর একটা আকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। বুক ও ঘাড়ের টিউমারগুলোরও ধীরে ধীরে অস্ত্রোপচার হবে।