এবার ভোরের অপেক্ষায় 'সুবোধ'

সূর্যটা এখানেও খাঁচাবন্দী। মানে অন্ধকার কাটেনি। তাই সুবোধের নতুন সঙ্গী এই শিশুটির জিজ্ঞাসায় নিখাদ ভোরের আকাঙ্ক্ষা। ‘সুবোধ’ সিরিজের নতুন গ্রাফিতিটি আঁকা হয়েছে আগারগাঁও–মহাখালী লিংক রোডের পুরাতন বিমানবন্দরের দেয়ালে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা l প্রথম আলো
সূর্যটা এখানেও খাঁচাবন্দী। মানে অন্ধকার কাটেনি। তাই সুবোধের নতুন সঙ্গী এই শিশুটির জিজ্ঞাসায় নিখাদ ভোরের আকাঙ্ক্ষা। ‘সুবোধ’ সিরিজের নতুন গ্রাফিতিটি আঁকা হয়েছে আগারগাঁও–মহাখালী লিংক রোডের পুরাতন বিমানবন্দরের দেয়ালে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা l প্রথম আলো

আবার কথা বলে উঠল নগরের দেয়াল। বিরূপ সময়ের কারণে ফেরারি ‘সুবোধ’ আবার ভাষা দিল প্রাণহীন নগরপ্রাচীরে। এবারের দেয়ালচিত্রে ভোরের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে পলায়নপর সুবোধ। এখানে তার সঙ্গী এক কন্যাশিশু, মোরগ আর খাঁচাবন্দী সেই সূর্যটা।
এ ধরনের দেয়ালচিত্র পরিচিতি ‘গ্রাফিতি’ নামে। নতুন করে সুবোধের দুটি গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে আগারগাঁও-মহাখালী লিঙ্ক রোডে পুরোনো বিমানবন্দরের দেয়ালে। এর একটিতে দেখা যায়, বসে থাকা সুবোধ এক কন্যাশিশুর কাঁধে হাত দিয়ে আছে। অন্য হাতে ধরে রাখা সুবোধের সার্বক্ষণিক সঙ্গী খাঁচাবন্দী সূর্য। পাশে লেখা, ‘সুবোধ, কবে হবে ভোর?’। পাশের আরেকটি ছবিতে দেখা গেল, তারে ঝোলানো বন্দী সূর্যটার দিকে গলা বাড়িয়ে একটা মোরগ প্রাণপণে ডেকে যাচ্ছে। আগের গ্রাফিতিগুলোর মতো এখানেও লোগো আকারে ব্যবহার করা হয়েছে একটি শব্দ: ‘হবেকি’ (HOBEKI?)।
রাজধানীর বিভিন্ন দেয়ালে আঁকা সুবোধের আগের চিত্রগুলোতে সুবোধ কখনো হাতে খাঁচাবন্দী সূর্য নিয়ে পালাতে উদ্যত, কখনো জেলে বন্দী, কখনো হতাশায় নুয়ে পড়া এক মানুষ। ‘সুবোধ কেন পালাবে’ শিরোনামে ওই চিত্রগুলোর গল্প গত ২ জুন সংবাদ হয়েছে প্রথম আলোয়। দেয়ালের সুবোধ উঠে এসেছে অনেক তরুণের টি-শার্টে। তবে এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি সুবোধের পরিচয় কিংবা তার পালিয়ে বেড়ানোর কারণ।
চিত্রসমালোচকেরা বলছেন, কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার একটা শিল্পিত মাধ্যম হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রাফিতি জনপ্রিয়। তবে বাংলাদেশে আগে এর ব্যবহার তেমন দেখা যায়নি।
বিভিন্ন দেশে প্রতিরোধ আন্দোলনে গ্রাফিতি অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠার নজির আছে। নিকট অতীতে দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন কিংবা সম্প্রতি যাদবপুরে শিক্ষার্থী নিগ্রহের প্রতিবাদে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনেও ছিল গ্রাফিতির উপস্থিতি। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি...আইজুদ্দিন’ দেয়াললেখাটি বেশ নজর কেড়েছিল। পরের দশকে দেখা গেল আরেকটি দেয়াললিখন, ‘অপেক্ষায়... নাজির’। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে অনেকে এগুলোকে ব্যাখ্যা করতেন।
সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায়ও চোখে পড়ে এমন একটি দেয়াললিখন। সেখানে লেখা, ‘অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাঁচব না। একটু খবর পৌঁছে দেবেন। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টন...।’

ঢাকার দেয়ালে গ্রাফিতি
ঢাকার দেয়ালে গ্রাফিতি

শিল্পসমালোচক মোস্তফা জামান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সুবোধের গ্রাফিতিগুলো আঁকা হয়েছে স্টেনসিল (লেখা বা আঁকার জন্য ছিদ্রময় পাত) ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে স্প্রে করে দ্রুত আঁকার কাজ করা যায়। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্রাফিতি আঁকিয়ে ব্যাঙ্কসি (Banksy) স্টেনসিল ব্যবহার করে গ্রাফিতি আঁকেন।
কলকাতার মনফকিরা থেকে প্রকাশিত গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প নামের গ্রন্থে লেখক বীরেন দাশ শর্মা গ্রাফিতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, ‘এক অর্থে গ্রাফিতি সাহিত্য না হয়েও লেখার শিল্প, চিত্রকলা না হয়েও অঙ্কনশিল্প।’
ফেসবুকসহ গণমাধ্যমের নানা পরিসরে সুবোধের গ্রাফিতি নিয়ে আলোচনা ও কৌতূহলের মধ্যেই এটা নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন পার্থ প্রতীম দাস নামের এক শৌখিন নির্মাতা। ‘সুবোধের খোঁজে’ শিরোনামের ওই তথ্যচিত্রে তিনিও অনেকের মতো উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন দেয়ালে দেয়ালে সুবোধের রেখে যাওয়া বার্তার অর্থ। তথ্যচিত্রটি দেখা যাবে এই ঠিকানায়: (https://www.youtube.com/watch?v=klZEdKIcMqI)
তরুণ এই নির্মাতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি নিরেট দেয়ালও যে কতখানি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে, তার প্রমাণ সুবোধের দেয়ালচিত্রগুলো। এর আঁকিয়েরা দেখাতে চেয়েছেন, সময়টা আমাদের কারোর পক্ষে যাচ্ছে না। আর সে কথা বলছে দেয়াল।’
সুবোধের আগের দেয়ালচিত্রগুলোর একটি আঁকা হয়েছে আগারগাঁও থেকে শিশু মেলার দিকে যেতে বাঁ দিকের দেয়ালে। সেখানে সুবোধ বাক্সবন্দী একটা হলুদ সূর্য হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে লেখা, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।’ রোকেয়া সরণিতে আবহাওয়া অফিসের বিপরীত পাশে পুরোনো বিমানবন্দরের দেয়ালে একই ভঙ্গিতে দাঁড়ানো সুবোধ। তবে সেখানে বাক্সবন্দী সূর্যটার রং লাল। পাশে লেখা, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই।’ আর আগারগাঁও-মহাখালী লিংক রোডে পুরোনো বিমানবন্দরের দেয়ালে এক সারিতে আঁকা সুবোধের তিনটি গ্রাফিতি। এর একটিতে সুবোধ হতাশায় নতমুখ, একটিতে পালানোর ভঙ্গিতে, আরেকটিতে কেবল বাক্সবন্দী সূর্যটা দড়িতে ঝোলানো।
ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের দেয়ালে আঁকা ছিল পলায়নপর সুবোধের আরেকটি চিত্র। তবে এখন তা চাপা পড়ে আছে রাজনৈতিক পোস্টারের নিচে।
মিরপুরের পূরবী সিনেমা হলের কাছে একটি দেয়ালেও আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি। আরেকটি গ্রাফিতি আছে শেরেবাংলা নগর বালক উচ্চবিদ্যালয়-সংলগ্ন পাওয়ার হাউসের দেয়ালে। তাতে লেখা, ‘সুবোধ এখন জেলে, পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের মনে।’
গ্রাফিতির ইতিহাস এতই পুরোনো যে প্রাচীন মিসর, গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে এর নিদর্শন পাওয়া যায়। এই শিল্পকর্মগুলোর মূল উপজীব্য সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ঘটনা। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভেতর দিয়ে কখনো এগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয় যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য কিংবা শান্তির বার্তা। কখনো এটি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, প্রচলিত নীতি কিংবা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শৈল্পিক রূপ। তবে অনেক দেশে গ্রাফিতি নিষিদ্ধ।
আগের দেয়ালচিত্রগুলোয় খাঁচাবন্দী সূর্য ছিল পলায়নপর সুবোধের একমাত্র সঙ্গী। এবার আশাবাদী সুবোধের পাশে আছে প্রজন্মের প্রতীক শিশু আর নতুন ভোর ডেকে আনার প্রতীক মোরগ। কৌতূহল থাকবে, আবার কোন রূপে হাজির হয় সুবোধ!