মিটিমিটি জ্বলছে জোনাকী!

>

নাগরিক বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম চলচ্চিত্র। ষাট ও সত্তরের দশকে ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে দেশ-বিদেশের নতুন, আলোচিত সব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। নব্বইয়ের দশকের শেষ প্রান্তে এসে দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্পে মন্দা শুরু হয়। তার প্রভাব পড়ে সিনেমা হলের ব্যবসায়। গত আড়াই দশকে ঢাকায় তিনটি সিনেপ্লেক্স হলেও নতুন কোনো সিনেমা হল তৈরি হয়নি। এই শহরে নব্বইয়ের দশকে অর্ধশত সিনেমা হল থাকলেও কমতে কমতে হলের সংখ্যা এখন ২৬টিতে এসে ঠেকেছে। পুরোনো এসব হল নিয়েই এই সাপ্তাহিক আয়োজন

জোনাকী সিনেমা হলের মূল অবকাঠামোসহ কোনো কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি এই দীর্ঘ সময়ে। হলের লবিতে দর্শকেরা l ছবি: প্রথম আলো
জোনাকী সিনেমা হলের মূল অবকাঠামোসহ কোনো কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি এই দীর্ঘ সময়ে। হলের লবিতে দর্শকেরা l ছবি: প্রথম আলো

শুক্রবার। বিকেল ২টা ৫০। নয়াপল্টন। জোনাকী সিনেমা হলের নিচের ক্যানটিন থেকে তখন কয়েকজন এসে কোমল পানীয় আর চিপস কিনে পাশের সোফায় গিয়ে বসল। বেল বাজল। শুরু হলো দুলাভাই জিন্দাবাদ সিনেমা। চলচ্চিত্রটি গতকালই মুক্তি পেয়েছে।
এমনিতে বাংলাছবির বাজার মন্দা। তার ওপর বৃষ্টির বেরসিক আচরণ। হলের সামনের রাস্তা জলমগ্ন। এত কিছুর মধ্যে ভিড় বলতে যা, তা শুধু শুক্রবার ছুটির দিনের উপহার।
নয়াপল্টনের এই এলাকার পরিচয় জোনাকী সিনেমার হলের নামে। ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে রিকশা কিংবা যেকোনো বাহনের চালককে ‘জোনাকীর সামনে’ বললে ঠিকঠিক নিয়ে আসবেন এখানে। একসময় প্রতিদিন, প্রতি শোতে দর্শকে গমগম করত এই জোনাকী। পুরান ঢাকা পেরিয়ে মতিঝিলের উত্তরে যখন কোনো হল হয়নি, তখন এই জোনাকী ছিল রুপালি পর্দার বড় আশ্রয়।
কিন্তু এখন সবটাই গল্পকথা। রাজধানীর সিনেমা হলগুলোর ‘একে একে যেন নিভিছে দেউটি’র মধ্যে কোনোমতে টিমটিম করে জ্বলছে জোনাকী হল। ২০১৮ সালে অর্ধশত বছর পার করবে হলটি। তবে জোনাকীর শরীরে এখনই বয়সের ছাপ স্পষ্ট।
হলটির উদ্যোক্তা বাংলাদেশ পুলিশ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে এই সমিতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। পরের বছর সদস্যরা একটি সিনেমা হল করার উদ্যোগ নেন। কয়েক বছরে ২২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৮ টাকা খরচ করে নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৬৮ সালের শুরুতে। তখনই বছরে ২ লাখ ১০ হাজার টাকায় মেসার্স পপুলার সিনে করপোরেশনকে হলটি ইজারা দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালের ২২ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের সৌজন্যে পরীক্ষামূলকভাবে সিনেমা প্রদর্শন হয়।
উদ্বোধনের আগে থেকেই জোনাকী হলের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেই চাকরিতে ঢুকে পড়েন এখানে। হলের সঙ্গে তাঁর চাকরির বয়সও ৫০ পেরোবে আগামী বছর। টিকিট বুকিং ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এখন ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার)। শুরুর দিকের কথা জানতে তাঁর স্মৃতিতে কড়া নাড়তেই খুলে গেল ’৬৮ সালের জোনাকীর দ্বার। তারিখটা ৯ মার্চ, ১৯৬৮। সমিতির তৎকালীন চেয়ারম্যান এ এস এম আহাম্মদ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইবনে মিজানের রাখাল বন্ধুর একটি রিল পপুলার সিনে করপোরেশনের চেয়ারম্যান আবদুল আওয়ালকে দেন শো চালু করার জন্য। সিনেমা হলের হস্তান্তর দলিল পপুলার সিনে করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন চৌধুরীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানের পরই সিনেমা হল চালু হয়।
মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, চালু হওয়ার প্রথম মাস থেকেই দারুণ সাড়া ফেলেছিল জোনাকী। দল বেঁধে মানুষ ছবি দেখতে আসত। বিশেষ করে পরিবার পরিজন নিয়ে দেখার জন্য জোনাকী ছিল ওই সময়ের প্রথম পছন্দ। কেননা, মতিঝিলের এই পাশটাতে (নতুন ঢাকা) তখন অন্য হল ছিল না। শুধু হল দেখার জন্যও মানুষ আসত। তিনি জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় পরিবার নিয়ে বেশ কয়েকবার জোনাকী হলে এসেছিলেন।

রাজধানীর নয়াপল্টনের মূল সড়কে জোনাকী সিনেমা হল। হলটির ৫০ বছর পূর্তি হবে আগামী বছর
রাজধানীর নয়াপল্টনের মূল সড়কে জোনাকী সিনেমা হল। হলটির ৫০ বছর পূর্তি হবে আগামী বছর

তখন তিন ভাগে আসনবিন্যাস হতো। শুরুর বছর প্রথম শ্রেণির টিকিট মূল্য ছিল ৩ টাকা ৬০ পয়সা, দ্বিতীয় শ্রেণির ২ টাকা ১০ পয়সা এবং তৃতীয় শ্রেণি ছিল ৮০ পয়সা। তিন শ্রেণির নাম ছিল যথাক্রমে বিলাস, সুধী এবং জনতা। বর্তমানে টিকিটের মূল্য যথাক্রমে ৭০, ৬০ ও ৫০ টাকা।
শুরুতে এই প্রতিষ্ঠানে ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল। এখন আছে ১৬ জন। শুরুর দিকে নিশি হলো ভোর, সংসার, সাত ভাই চম্পা, বাঁশরী, এতটুকু আশা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী জোনাকী হলে চলেছে। পরের বছর দেশের প্রথম নারী চিত্রপরিচালক রেবেকার বিন্দু থেকে বৃত্ত আগ্রহ নিয়ে দেখেছিল দর্শক।
সে সময় ঢাকায় নানা দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে উৎসব হতো। চলচ্চিত্র উৎসবের কথা মনে করছিলেন মগবাজারের বাসিন্দা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা শফিকুর রহমান। রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালনকারী শফিকুর রহমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জোনাকী হলের ছবি দেখার অনেক স্মৃতির মধ্যে ’৭০ সালে দল বেঁধে দেখতে গিয়েছিলেন জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া ছবিটি। অগ্রিম টিকিট কেটে উদ্বোধনের দিন হলে গিয়ে দেখেন পোস্টার নামিয়ে ফেলছেন কর্মীরা। ছবিটি প্রদর্শনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। মিছিল হলো ছবির জন্য।
মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পরে ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে অশনি সংকেত দেখতে জনস্রোতের কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে শফিকুর রহমানের। অনেক যুদ্ধ করে টিকিট কেটে দেখেন একদম সামনের সারিতে আসন, ঘাড় উঁচু করে পর্দায় তাকাতে হচ্ছে। ’৭০ ও ’৮০ দশকে নিয়মিত ছবি দেখার অভ্যাস ছিল তাঁর। সর্বশেষ স্ত্রীকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার দেখেন জোনাকীতে।
পরিবার নিয়ে ছবি দেখতে আসার প্রমাণ মিলল গতকালও। জলমগ্ন রাজপথ পাড়ি দিয়ে আসা বেশ কয়েকজন মহিলা দর্শককে দেখা গেল হলে। বুকিংয়ের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানালেন অনেক দিন পর ডিপজলের ছবি মুক্তি পেয়েছে। সঙ্গে মৌসুমী এবং লাক্স সুন্দরী মিম। তাই দর্শকের সক্রিয় উপস্থিতি।
একটু পরপর হলের ভেতর থেকে তালি আর শিস শোনা যাচ্ছিল। সেই সূত্র ধরে হলের ভেতরে যাওয়া। দর্শক আছে, তবে অর্ধেক আসন খালি।
শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে দর্শক ‘এক ছটাকও হয় না’—বললেন হলের হিসাব কর্মকর্তা বাসুদেব। ’৮৯ সাল থেকে কাজ করছেন তিনি। ব্যবসা নিয়ে তিনি পুরোপুরি হতাশ। তাঁর মতে, মূলত ছবির সংকটই দর্শকের উপস্থিতি কমিয়ে দিয়েছে। এখন মানুষ ইউটিউবে, মোবাইলেই ছবি দেখতে পায়। এ অবস্থায় মাসিক ভাড়া দিয়ে হল চালানো মুশকিল।
বাসুদেবের হতাশায় সুর মেলালেন হলের সহব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম। বিস্ময় নিয়ে বললেন, এককালে এই জোনাকী হলের টিকিট বিক্রি হতো ফকিরাপুল বাজারে। আর এখন প্রতি মাসে লোকসান গুনতে হয়।
শুরুর পর হলের মূল অবকাঠামোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। মূল ভবনের সামনের অংশে নান্দনিক কাজ, রাখালের বংশীবাদন, নৌকা আর জেগে ওঠা সূর্য জোনাকীকে আলাদা করেছে রাজধানীর অন্য প্রেক্ষাগৃহগুলো থেকে।
বাংলাদেশ পুলিশ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের বর্তমান সচিব এস এম শরীফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বললেন, হল নিয়ে নতুন পরিকল্পনা আছে। তবে তা চূড়ান্ত হয়নি বলে এখন বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অন্য পরিকল্পনা আছে বলেই লিজ না দিয়ে এখন হল ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নতুন করে এখানে কী হবে তা সমিতির পরিচালনা পর্ষদ ঠিক করবে। এটা ভেঙে নতুন করে হল হোক কিংবা বাণিজ্যিক বিতান হোক, ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হবে। জোনাকীর স্মৃতি থাকবেই।
তবে সমিতির ওয়েবসাইটে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বলা আছে, জোনাকী সিনেমা হল ভবন ভেঙে বহুতলবিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা হবে। শুক্রবার বেশ খানিকটা সময় জোনাকী হলে থেকে আর মুঠোফোনে কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে একটি ইঙ্গিত মেলে, বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীর এই স্থানে এই চেহারায় জোনাকী হল থাকবে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়তো বাণিজ্যিক মলের একটা অংশ হবে জোনাকী। সবকিছু আধুনিক হবে, তবে নামটি থেকে যাবে সময়ের সাক্ষী হয়ে।

প্রতিষ্ঠাতা
বাংলাদেশ পুলিশ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। ইজারা নিয়ে মেসার্স পপুলার সিনে করপোরেশন হলটির কার্যক্রম শুরু করে। এখন ভাড়ায় চলছে।
প্রতিষ্ঠাকাল
৯ মার্চ, ১৯৬৮। ইবনে মিজানের রাখাল বন্ধু প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু। এর আগে ওই বছরের ২২ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে একটি সিনেমা দেখেন উদ্যোক্তার প্রতিনিধিরা।
ধারণক্ষমতা
১ হাজার ৫ জন
প্রদর্শনীর সময়সূচি
প্রতিদিন ৪টি প্রদর্শনী। দুপুর ১২টা, বেলা সাড়ে ৩টা, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা প্রদর্শনী ও রাত ৯টা। শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় ‘মর্নিং শো’