ক্ষতিপূরণের জটে মৃত শ্রমিকের স্বজনেরা

২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিদেশ থেকে ১৮ হাজার ৪২৯ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ দেশে এসেছে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিদেশ থেকে ১৮ হাজার ৪২৯ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ দেশে এসেছে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিদেশে কর্মরত অবস্থায় গত সাত বছরে যেসব শ্রমিক মারা গেছেন, তাঁদের ৭৫ শতাংশের পরিবারই কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বিদেশে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তির দুর্বলতা, জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নজরদারির অভাব এবং দূতাবাসগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন অভিবাসী শ্রমিকেরা।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিশ্বের ১৬০টি দেশে ১ কোটি অভিবাসী শ্রমিক আছেন। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিদেশ থেকে ১৮ হাজার ৪২৯ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ এসেছে। কিন্তু বিদেশে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে সাড়ে ৪ হাজার শ্রমিকের পরিবার।
জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ যা-ই হোক না কেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত। আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু বিষয়টা দ্বিপাক্ষিক। শুধু আমরা চাইলেই তো আর চলবে না।’
জানা গেছে, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রথম শর্ত হলো, শ্রমিককে বৈধ হতে হবে। চুক্তির দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা শুধু কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে তাঁদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য বলে গণ্য করা হয়। অন্য কোনো কারণে মৃত্যু হলে শ্রমিকদের পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায় না।
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১ কোটি শ্রমিকের কতজন বৈধ, সে সম্পর্কে সরকারের হাতে পরিষ্কার কোনো তথ্য নেই। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম। গত বছর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২ হাজার ৯৭০ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃতদেহ পৌঁছায়; তাঁদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৭৩১। বেশির ভাগ শ্রমিক মারা গেছেন হৃদ্রোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে। তা ছাড়া যেসব পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য, তাদেরও বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের ৫ হাজার ৭৭৯টি দাবি অনিষ্পন্ন ছিল। তার মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই অনিষ্পন্ন ছিল ৩ হাজার ১৪৭টি মামলা।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল বয়সে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা বিদেশে যাচ্ছেন। তাঁরা কেন হৃদ্রোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের মতো রোগে মারা যাচ্ছেন, তা কখনো সরকারি কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখেনি। তাঁরা বিদেশে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পান না।
জনশক্তি রপ্তানিকারক নেপাল, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা আছে। নেপালের অভিবাসী শ্রমিকেরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায়ও ইনস্যুরেন্স-সেবা পেয়ে থাকেন। শ্রীলঙ্কায় বিদেশে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও দেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইনস্যুরেন্স-সেবা নিশ্চিত না করলে শ্রীলঙ্কা থেকে অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো হয় না। কিন্তু দেশে এই ব্যবস্থা নেই।

অভিযোগ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের বিরুদ্ধে
বাংলাদেশ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসে কোনো শ্রমিক মারা গেলে সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে জানানো হয়। বোর্ড আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে মৃতদেহ দেশে আনা বা বিদেশেই দাফনের ব্যবস্থা করে। অথবা প্রবাসী শ্রমিকের আত্মীয়স্বজন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে জানালে বোর্ড দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে মৃতদেহ দেশে আনা বা বিদেশে দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য বোর্ডের মাধ্যমে কাগজপত্র দূতাবাসে পাঠানো হয়। দূতাবাস আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা করে। মামলা নিষ্পত্তি হলে মৃত শ্রমিকদের স্বজনেরা ক্ষতিপূরণ পান।
মৃত শ্রমিকদের স্বজনেরা বলছেন, দূতাবাসে কাগজপত্র পাঠানো পর্যন্ত কাজগুলো দ্রুত আগায়, কিন্তু সমস্যার সুরাহা হয় না। প্রিয়জন হারিয়েছেন এমন কমপক্ষে ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা নিয়ম অনুযায়ী সব কাগজপত্র প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে জমা দিয়েছেন। কল্যাণ বোর্ড বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে সেই কাগজপত্র পাঠিয়েছে বলেও তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন, কিন্তু তারপর আর কোনো খবর পাচ্ছেন না।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মো. জুলহাজ প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিপূরণ একটা বিচারিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেওয়া হয়। আদালতের কাজে হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড অবশ্য বৈধ শ্রমিক যে কারণেই মারা যান না কেন, তাঁর মৃতদেহ সৎকারের জন্য ৩৫ হাজার টাকা এবং ৩ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে থাকে।

ক্ষতিপূরণের জন্য অপেক্ষা
অনিষ্পন্ন মামলাসংখ্যার দিক থেকে শীর্ষে আছে সৌদি আরব। শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে বাকি দেশগুলো হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান ও কাতার। ২০০৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের রিয়াদে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মোশাহিদ আলী। ৮ অক্টোবর মোশাহিদ আলীর ভাই আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মারা যাওয়ার পর সরকার থেকে বলেছিল, বিদেশ থেকে ক্ষতিপূরণ পেলে সরকারি অনুদান পাওয়া যাবে না। মোশাহিদ আলীর পরিবার সরকারি অনুদান পায়নি, সৌদি আরব থেকেও কোনো টাকা পায়নি।
একই অভিযোগ করেছেন শাহানা আক্তার। তাঁর স্বামী সুরত আলীও সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ২০১২ সাল থেকে ক্ষতিপূরণের অপেক্ষা করছেন। তিন সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য শাহানা এখন ঠিকা ঝিয়ের কাজ করেন। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দূতাবাস মামলা একটা করেছিল বলে শুনেছিলেন তিনি। সেই মামলা চলে কি না তাঁর জানা নেই।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরবের আদালতে দীর্ঘসূত্রতা আছে। বাংলাদেশ দূতাবাসেরও কিছু সমস্যা রয়েছে। শুধু রিয়াদ ও জেদ্দা থেকে নিয়মিত মামলার শুনানিতে অংশ নিতে পারছেন না দূতাবাসের লোকজন।

গলতি আরও
বৈধ শ্রমিক অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতারণায় বিদেশে গিয়ে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। যে কাজের কথা বলে শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়, তাঁরা প্রায়ই বিদেশে গিয়ে সেই কাজ পান না। অনেকেই বাধ্য হয়ে চাকরি বদল করেন বা পালিয়ে যান। এভাবে তাঁরা অবৈধ হয়ে যান। কোনো কারণে মারা গেলে তাঁদের স্বজনেরা বিদেশে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পান না, সরকারও কোনো অনুদান দেয় না।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি বায়রার পরামর্শক ও সাবেক সচিব দলিল উদ্দিন মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন শ্রমিক গাড়িচালক হিসেবে বিদেশে যাওয়ার অনুমতিপত্র নিচ্ছেন, কিন্তু তিনি গাড়ি চালাতে পারেন না। বিদেশে গিয়ে অন্য কোনো কাজে যুক্ত হচ্ছেন। অনেক সময় শ্রমিকেরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়েও যান। তখন তাঁরা অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন।’