দুই বিদ্যালয়ে শিক্ষক থেকেও নেই, ভাড়াটেই ভরসা!

তারাগঞ্জের সয়ার শ্যামগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছে লুঙ্গি পরিহিত এক কিশোর। ছবিটি গত বুধবার বিকেলে তোলা l প্রথম আলো
তারাগঞ্জের সয়ার শ্যামগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছে লুঙ্গি পরিহিত এক কিশোর। ছবিটি গত বুধবার বিকেলে তোলা l প্রথম আলো

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনার করুণ অবস্থা। প্রকৃত শিক্ষক থেকেও নেই। ভাড়াটে শিক্ষকেই ভরসা! বিদ্যালয় দুটি হলো সয়ার ধোলাইঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সয়ার শ্যামগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এলাকার অভিভাবকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার ওই দুই বিদ্যালয় সরেজমিনে ঘুরে ওই চিত্র পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রমিতা ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘ওই দুই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকা ও সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি) না করানোর অভিযোগে ইতিমধ্যে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছি।’

ওই দিন বেলা আড়াইটায় সয়ার ধোলাইঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা যায়, সেখানে দুজন ক্লাস নিচ্ছেন। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাঠে খেলছে। এক শিক্ষার্থী বলে, ‘স্যার নাই। ক্লাস হয়চে না।’ আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘হামার ক্লাস বেশি হয় না। সারা দিন খেলাই।’ এ সময় পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছিলেন এক যুবক। জানা গেল, তাঁর নাম নুরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘আমি এখানকার শিক্ষক নই। প্রধান শিক্ষক আমাকে কিছু টাকা দেন, তাই ক্লাস নিই।’ পাশের কক্ষে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নিতে দেখা যায় বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রমানাথ চন্দ্র রায়কে। কিছুক্ষণ পরই বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি ঘণ্টাখানেক আগে একটু বাইরে গিয়েছিলাম।’

 খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যালয়টি ১৯৯৫ সালে স্থাপিত। সেখানে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১৬৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষকের পদ চারটি। চার পদেই শিক্ষক আছেন। ওই দিন বেলা তিনটা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে অবস্থান করেও সহকারী শিক্ষক সুজাউল হক ও আরজিনা বেগমকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, সকালে দুই শিক্ষকই ছিলেন। দুপুর ১২টায় শিক্ষক সুজাউল বিদ্যালয়ের কাজে শিক্ষা অফিসে গেছেন। আর আরজিনার সন্তান অসুস্থ হওয়ায় তিনি টিফিনের পর ছুটি নিয়েছেন। কিন্তু আরজিনার ছুটির আবেদন দেখাতে পারেননি প্রধান শিক্ষক।

ধোলাইঘাট এলাকার অভিভাবক আইয়ুব আলী অভিযোগ করে বলেন, সব শিক্ষক স্কুলে আসেন না। দুই-একজন এলেও কখন আসেন কখন যান, তার ঠিক নেই। ক্লাস নেন ভাড়াটে শিক্ষক।

বেলা সোয়া তিনটার দিকে সয়ার শ্যামগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা যায়, সেখানে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলছে। পঞ্চম শ্রেণিতে লুঙ্গি পরে ইসলাম ধর্ম ক্লাস নিচ্ছিল ১৪-১৫ বছরের এক কিশোর। জানতে চাইলে বলে, ‘আমার নাম শিপন মিয়া। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোর্শেদা আপা নেই। তাঁর পরিবর্তে আমি ক্লাস নিচ্ছি।’ তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছিলেন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোতাহার হোসেন। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষক। শিল্পী বেগম নামে একজন সহকারী শিক্ষক রংপুরে প্রশিক্ষণে গেছেন। প্রধান শিক্ষক আবদুল মতিন সরকার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গেছেন। সহকারী শিক্ষক মোর্শেদা বেগম টিফিনের সময় চলে গেছেন। কথা বলতে বলতেই মোটরসাইকেলে চেপে বিদ্যালয়ে আসেন প্রধান শিক্ষক মতিন। এরপরই লুঙ্গি পরা ওই কিশোর বিদ্যালয় ত্যাগ করে। জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আপনি (সাংবাদিক) ভুল দেখেছেন। লুঙ্গি পরা কোনো কিশোর বিদ্যালয়ে ক্লাস নেয় না।’ এরপর ওই কিশোরের ক্লাস নেওয়ার ভিডিও চিত্র দেখানো হলে তিনি বলেন, ‘ওই ছেলে মাধ্যমিকের ছাত্র। সে গরিব। তাকে আমরা কিছু সম্মানী দিয়ে রেখেছি।’ বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির বিষয়ে মোর্শেদা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তান একটু অসুস্থ ছিল। তাই টিফিনের সময় চলে এসেছি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রমিতা ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ে ভাড়াটে শিক্ষক রাখার বিধান নেই। অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।