জাল নথি দিয়ে কোটি টাকার জমি বিক্রি

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় জাল নথির মাধ্যমে একই খতিয়ান ও দাগভুক্ত ১৯ শতক জমি বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুবার ওই জমি বিক্রি হয়েছে। জমিদাতার নাম এক হলেও রেজিস্ট্রি করা দুটি দলিলে (সাফ কবলা) দুই ব্যক্তির ছবি রয়েছে।

উপজেলার আঠারোবাড়ী ইউনিয়নের গলকুণ্ডা মৌজায় ওই জমির অবস্থান। এর পাশেই রয়েছে এই অঞ্চলের বৃহৎ পাইকারি বাজার ‘রায়েরবাজার’। ওই ১৯ শতক জমির বর্তমান বাজারমূল্য কোটি টাকার বেশি।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জমি বিক্রির প্রথম দলিলটি হয় গত ১৬ অক্টোবর। দলিল নম্বর ৫৬১২। কিনেছেন রায়েরবাজারের ব্যবসায়ী সাদেক মিয়া, হাবিবুর রহমানসহ ১০ জন। জমিদাতা ছিলেন জমরত মিয়ার ছেলে আবুল হাসেম। দ্বিতীয় দলিলটি নিবন্ধিত হয়েছে ২৯ অক্টোবর। দলিল নম্বর ৫৭৯৯। কিনেছেন বায়েরবাজারের ব্যবসায়ী কাজল মিয়া, ফেরদৌস মিয়াসহ সাতজন। জমিদাতা ছিলেনজমরত মিয়ার ছেলে আবুল হাসেম। দুটি দলিলে জমিদাতার ছবি ও স্বাক্ষর ভিন্ন।

গত রোববার সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় সাব-রেজিস্ট্রার মো. হায়দার আলী খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দলিল পেশ করার সময় জমির হালনাগাদ খাজনা পরিশোধের রসিদ ও বিআরএস খতিয়ানের অনুলিপি জমা নেওয়া হয়। এসব কাগজপত্রে ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকে। তাঁর কার্যালয়েও ওই কর্মকর্তার স্বাক্ষর সংরক্ষিত রয়েছে। দুটি স্বাক্ষরের মিল পাওয়া গেলেই দলিলটি রেজিস্ট্রি করা হয়। জাল দলিলের বিষয়ে কেউ আগাম অভিযোগ দিলে নজরদারি করা হয়। আর যদি জাল নথিপত্র দিয়ে জমির দলিল হয়, তখন আদালত তা ফয়সালা করবেন।

রায়েরবাজারের ছয়জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গলকুণ্ডা মৌজার জমরত মিয়ার ছেলে আবুল হাসেম এই বাজারে লেপ-তোশকের ব্যবসা করতেন। তিনি ‘আবুল হাসেম বিহারি’ নামে পরিচিত। বর্তমানে তিনি তাঁর মেয়ে লাইলি আক্তারের বাড়িতে থাকেন। লাইলির শ্বশুরবাড়ি নেত্রকোনার মদন উপজেলায়। মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করা হলে লাইলি বলেন, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে বাবাকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। গত ২৯ অক্টোবর তাঁর বাবা ঈশ্বরগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে রায়েরবাজারের পাশের জমির দলিল রেজিস্ট্রি করেছেন।

অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেমকে রায়েরবাজার চাটাইমহালে তাঁর দোকানে পাওয়া যায়। আলাপচারিতার একপর্যায়ে এই প্রতিবেদক নিজের নোটবুকে আবুল হাসেমের নাম ও ঠিকানা লেখার অনুরোধ করেন। সেখানে তিনি লেখেন—‘নাম: আবুল হাসেম, বাবার নাম: জমত আলী।’ গলকুণ্ডা মৌজায় ১৯ শতক জমির মালিকানা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে আঠারোবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের তৎকালীন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাঁকে বলেন, ৫১৮ দাগের ১৯ শতক জমি তাঁর নামে রেকর্ড হয়েছে। ওই কার্যালয় থেকে তাঁর নামে খাজনা পরিশোধের রসিদ (চেক) দেওয়া হয়। সেই হিসেবে জমির মালিক তিনি।

তবে বিআরএস রেকর্ডে জমির মালিকের বাবার নাম লেখা রয়েছে জমরত মিয়া। বাবার নাম পাল্টে যাওয়া প্রসঙ্গে আবুল হাসেম বলেন, বিষয়টি ভূমি অফিস বলতে পারবে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভোটার তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত পরিপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর বাবার নাম জমত আলী ভূঁইয়া লেখা রয়েছে।

আঠারোবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে ১৯৮৪ সালের বাংলাদেশ রেকর্ড অব সার্ভে (বিআরএস) অনুযায়ী গলকুণ্ডা মৌজার ২৪৬ নম্বর খতিয়ানের চারটি দাগে ২৯ শতক জমি থাকার তথ্য পাওয়া যায়। চারটি দাগ হচ্ছে ৩৩৭, ৫১৮, ৫২১ ও ৫২৪। জমির মালিক হিসেবে জমরত মিয়ার ছেলে আবুল হাসেমের নাম রয়েছে। ৩৩৭, ৫২১ ও ৫২৪ দাগের বাড়ি শ্রেণির ১০ শতক জমি আবুল হাসেম পাঁচ বছর আগে বিক্রি করেছেন। ৫১৮ দাগের ডোবা শ্রেণির জমি অবিক্রীত ছিল।

পৃথক দুই ব্যক্তির একই দাগ-খতিয়ানের জমির মালিক হওয়া প্রসঙ্গে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, তিনি সম্প্রতি এই কার্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। আগে এখানে কীভাবে, কী হয়েছে তা তিনি জানেন না।

এদিকে ক্রেতাদের দুটি পক্ষই দাবি করছে, ক্রয়সূত্রে তারা জমির মালিক। সাদেক মিয়া ও হাবিবুর রহমান দাবি করেন, ওই জমির বৈধ মালিক আবুল হাসেম। তাঁর কাছ থেকেই তাঁরা কিনেছেন। কাজল মিয়া ও ফেরদৌস মিয়া বলেন, তাঁদের ক্রয়ের দলিলই সঠিক।