শাস্তি নির্ধারণে গুরুত্ব পায় চার জনের সাক্ষ্য

মূলত চারজন আসামির জবানবন্দি চাঞ্চল্যকর ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের মামলা প্রমাণ ও ১৪ আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। যদিও ২৭ জনের সাক্ষ্যে এ ঘটনায় করা দুটি মামলার জট খোলে। বাকি ২৩ জনের জবানবন্দি উভয় মামলার অভিযোগ প্রমাণের ক্ষেত্রে উপাদান হিসেবে কাজ করেছে।
রায় বিশ্লেষণ করে এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারক এস এম মজিবুর রহমান দুটি মামলার রায় ঘোষণার সময়ও চার আসামির জবান-বন্দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন।
এই চার আসামি হলেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাবউদ্দিন আহমেদ ও মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান এবং চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান।
এ চারজন চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের তৎকালীন হাকিম মোহাম্মদ ওসমান গনি ও মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমানের আদালতে জবানবন্দি দিলে অস্ত্র আটক রহস্যের জট খোলে। গতকাল দেওয়া রায়ে বলা হয়, ‘এ রায়ে আমার মনগড়া কোনো মন্তব্য নেই। বরং আসামিরা একে অপরের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তাঁরা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অস্ত্র পাচারের সঙ্গে যুক্ত হন। এটা চাকরিবিধিরও পরিপন্থী।’
আদালত সূত্র জানায়, আসামি এনএসআইয়ের তখনকার মহাপরিচালক আবদুর রহিমের জবানবন্দিকে রায়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর সাহাবউদ্দিন এনএসআইয়ের পরিচালক এবং একই সঙ্গে মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। এ কারণে এই পরিচালক অতিমাত্রায় ক্ষমতার অপ্রয়োগ করেছেন, যা আবদুর রহিম জবানবন্দিতে বলেছেন। ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের পর তাঁকে বদলি করে বিমানবাহিনীতে পাঠানো হলে মার্কিন দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা সাহাবউদ্দিনের বদলির আদেশ ঠেকানোর জন্য আবদুর রহিমের কাছে তদবির করেন। এ কারণে সাহাবউদ্দিনের জবানবন্দিও সমান গুরুত্ব পায় আদালতের কাছে।
আদালতে সাহাবউদ্দিনের দেওয়া জবানবন্দিতে বলা হয়, পাকিস্তানের মালিকানাধীন দুবাইভিত্তিক এআরওয়াই গ্রুপের আমন্ত্রণে ২০০৩ সালে ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিম সস্ত্রীক দুবাই সফরে যান। সেখানে একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। একই বছর এআরওয়াই গ্রুপ আবদুর রহিমকে ৪০ হাজার পাউন্ড উপহার দেয়। সাহাবউদ্দিন এ অর্থ মহাপরিচালকের বাসায় পৌঁছে দেন। পরে শেরাটন হোটেলের একটি মানি এক্সচেঞ্জ থেকে এ অর্থ টাকায় রূপান্তর করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাহাবউদ্দিনের জবানবন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে আরও বলা হয়, ঢাকার সেফ হাউসে পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে নিয়ে একাধিক বৈঠক করেন এনএসআইয়ের মহাপরিচালক আবদুর রহিম। এসব বৈঠকে উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া উপস্থিত থাকতেন। ২০০৪ সালের মার্চে মহাপরিচালক রহিম তাঁর কক্ষে উইং কমান্ডার সাহাবউদ্দিন ও মেজর লিয়াকতকে ডেকে পাঠান। মহাপরিচালক বলেন, এআরওয়াই গ্রুপের অর্থায়নে ওই দেশের সহায়তায় কিছু অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি আসবে। এসব জানলেও কিছু করার দরকার নেই। এ নির্দেশ দিয়েই তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলে যান।
২৮ মার্চ মহাপরিচালক আবদুর রহিম আবারও পরেশ বড়ুয়া ও পাকিস্তানের তখনকার হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেন।
রায়ে এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খানের উদ্ধৃতিতে বলা হয়, সাহাবউদ্দিনের নির্দেশে আকবর হোসেন অস্ত্র পরিবহনের জন্য চট্টগ্রামের গ্রিনহাউস ট্রান্সপোর্ট থেকে ট্রাক ভাড়া করেন। অস্ত্র আটকের পর গ্রিনহাউসের মালিক হাবিবুর রহমান চট্টগ্রাম থেকে সাহাবউদ্দিনকে ফোন করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আপনার স্যার (সাহাবউদ্দিন) কী রকম লোকদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করে দিলেন? ওরা লবণ না নিয়ে অবৈধ অস্ত্র বোঝাই করেছে। পুলিশের কাছে তারা ধরা পড়েছে। আপনি আপনার স্যারের সঙ্গে কথা বলে আমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।’ অর্থাৎ লবণ বোঝাইয়ের কথা বলে সাহাবউদ্দিন মাঠ কর্মকর্তা আকবরকে ট্রাক ভাড়া করার জন্য চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যোগসাজশের বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান জবানবন্দিতে বলেছিলেন, মালামাল (অস্ত্র) খালাস বাবদ ৫০-৬০ লাখ টাকা লাগবে বলে পরেশ বড়ুয়াকে জানান হাফিজুর রহমান। পরেশ বড়ুয়া চারটি খাকি প্যাকেটে ৫০ লাখ টাকা দেন হাফিজুরকে। একইভাবে অস্ত্র পরিবহন নির্বিঘ্ন করতে পরেশ বড়ুয়ার সহযোগিতা চেয়েছিলেন হাফিজুর রহমান। পরেশ বড়ুয়া তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, বিষয়টি ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের কর্মকর্তারা তদারক করছেন।