এক শিক্ষকই প্রতিদিন নেন ২৬ ক্লাস!

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

‘আমি আর পারছি না, আমাকে একাই একটি বিদ্যালয় চালাতে হয়। শুক্রবার বাদে প্রতিদিন সকাল নয়টায় বিদ্যালয়ে এসে চারটি কক্ষের তালা খুলি, ঝাড় দিই। শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৬টি শ্রেণিতে ২৬টি ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। হাজিরা খাতায় নাম লিখতে হয়। নানা জরিপ ফরম পূরণসহ দাপ্তরিক নানা কাজ করতে হয়। আবার ঘণ্টাও বাজাতে হয়। পরীক্ষাও চালাতে হয়। মাসে কমপক্ষে চারবার সখীপুর প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে নানা কাজে যেতে হয়। এভাবে কি একটা স্কুল চালানো যায়? আমি আর পারছি না।’

এভাবেই দুঃখ করছিলেন সখীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল দাড়িয়াপুর ইউনিয়নের কাঙ্গালীছেও দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক সেলিনা আক্তার। কাগজে-কলমে তিনি নিজেও ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক নন। তিনি আসলে পাশের আকন্দপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। দক্ষিণপাড়া বিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষক অবসরে যাওয়ায় ১০ মাস আগে সেলিনা আক্তারকে বিদ্যালয়টিতে প্রেষণে পাঠানো হয়। তিন মাস ধরে তিনি একাই ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, এমনকি দপ্তরির দায়িত্ব পালন করছেন।

সখীপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-সংকটের কথা নিশ্চিত করে বলেন, শিগগিরই আরও দুজন শিক্ষক সেখানে দেওয়া হবে।

সরেজমিনে ৬ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় বিদ্যালয়টিতে দেখা যায়, সেলিনা আক্তার একাই তিন কক্ষের তিনটি ক্লাস নিচ্ছেন একসঙ্গে। একসঙ্গে পাঠদান করতে গিয়ে এক শ্রেণিকক্ষ থেকে অন্য শ্রেণিকক্ষে দৌড়াদৌড়ি করছেন। শিক্ষক যখন যে কক্ষে যাচ্ছেন, সেই শ্রেণিকক্ষ নীরব থাকলেও অন্য দুটিতে শুরু হয়ে যাচ্ছে গোলমাল, চেঁচামেচি। সেলিনা বলেন, ‘এই বিদ্যালয়ে কোনো পড়াশোনা নেই, ওদের সামলাতেই সময় চলে যায়। ক্লাসে বসেই অফিশিয়াল কাজকর্ম সারতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, যখন তিনি সখীপুর শিক্ষা কার্যালয়ে যান, তখন ওই গ্রামের একজনকে ক্লাস দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যেতে হয়।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি ২০১৩ সালে সরকারি হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কালাচান সরকার ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ, সহকারী শিক্ষক নরেশ চন্দ্র ২০১৬ সালের ১৮ জানুয়ারি, সুমন্ত সরকার ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ও গোলক চন্দ্র সরকার চলতি বছরের ১৩ আগস্ট অবসরে যান। সুমন্ত সরকার অবসরে যাওয়ার দিন পাশের বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সেলিনা আক্তার প্রেষণে যোগ দেন। গোলক সরকার অবসরে যাওয়ার পর থেকে সেলিনা আক্তার একা হয়ে পড়েছেন। তাঁকে প্রতিদিন বিদ্যালয়ের দুই শিফটে ছয় শ্রেণির মোট ২৬টি ক্লাস সামাল দিতে হয়।

পঞ্চম শ্রেণির অর্পিতা শিকদার নামের শিক্ষার্থী অভিযোগ করে, ‘কয়েক দিন পরই পিইসি (প্রাথমিক সমাপনী) পরীক্ষা। শিক্ষক না থাকায় পুরো বছর ভালোভাবে পড়া হয়নি। ফলাফল বেশি একটা ভালো হবে না। আমাদের বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি বীম বাবু সরকার ভারতে যাওয়ায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

অভিভাবক সদস্য আনন্দ মণ্ডল বলেন, এ গ্রামের বাসিন্দাদের ৯৫ ভাগই হিন্দুধর্মাবলম্বী। এ বিদ্যালয়ের চার শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পর আর কাউকে সরকার নিয়োগ দেয়নি। ফলে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষকের অভাবে পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আশপাশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে।