এ অগ্রহায়ণে বাজেনি শিঙাধ্বনি

গত শুক্রবার নরসিংদীতে হুমায়ুন সাধুর আখড়ায় গান করছেন টুনটুন বাউল l প্রথম আলো
গত শুক্রবার নরসিংদীতে হুমায়ুন সাধুর আখড়ায় গান করছেন টুনটুন বাউল l প্রথম আলো

মির্জানগর গ্রামে এ বছর শিঙার ধ্বনি শোনা যায়নি। অথচ ২৬ বছর ধরে হুমায়ুন সাধুর বাড়ি থেকে গ্রামবাসীর কানে পৌঁছাত সেই ধ্বনি। অগ্রহায়ণের ১০ তারিখ সন্ধ্যায় শিঙায় দীর্ঘ ফুৎকার বাজিয়ে সাধুসঙ্গ উদ্বোধন করতেন মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন ফকির। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য!

এই বছর সেটি হয়নি। নিজের আখড়ার উঠোনে সমাধি হয়েছে তাঁর। তবে গত মার্চে তিরোধানের পর কিন্তু থেমে যায়নি তাঁর শুরু করা নিয়মিত সাধুসঙ্গ। লালন-স্মরণ ও যে বাউল মেলা তিনি করে আসছিলেন, ভক্তরাই এ বছর সেই আয়োজন করেছেন। ধূপের ধোঁয়া ও শ্রদ্ধার ফুলে ঢাকা সমাধির অন্তঃপুরে তিনি ছিলেন শক্তি ও প্রেরণা হয়ে।

গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ফকির লালন তিরোধানের ৪০তম দিনে নরসিংদীর রায়পুরায় ছিল তাঁকে স্মরণ ও বাউল গানের বৃহৎ এক আসর। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত বহু বাউলসাধক এ আসরে লালনের গান শুনিয়েছেন। গানের ফাঁকে লালন-দর্শন ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছেন উপস্থিত হাজার দর্শককে। শুনিয়েছেন ‘আমি তোমার কাঙাল বন্ধু’, ‘এমনও সৌভাগ্য আমার কবে হবে’, ‘মানুষ অবিশ্বাসে পাইনে রে সে মানুষ-নিধি’ গানগুলো। শুধু গাইতে বা শুনতে নয়, সাধুসঙ্গে হাজিরা দিতে এসেছিলেন হুমায়ুন সাধুর দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সাথিরা। প্রতিবছর এই সাধুসঙ্গে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, যশোর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর থেকে আসেন বহু বাউলসাধক। এ বছর একসঙ্গে গান করেছেন তাঁরা, স্মরণ করেছেন প্রয়াত হুমায়ুন ফকিরকে।

বিশেষ অতিথি হিসেবে এসেছিলেন মির্জানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জালাল সরকার, নরসিংদী রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হাজী আবদুল সাত্তার, ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন বোটন। সেই সন্ধ্যায় মঞ্চে উঠে এসে কথা বলেন উত্তর মির্জানগর উপজেলা চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির। বন্ধু হুমায়ুন ফকিরকে স্মরণ করে তিনি বললেন, ‘তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, তাই মানুষ তাঁকে ভালোবেসে এখানে আসে। এই মানুষদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা।’

আসর জমে ওঠার পর দেখা হয় হুমায়ুন সাধুর শিষ্য রেজা ফকিরের সঙ্গে। তিনি জানালেন, গুরুর সঙ্গে ভীষণ প্রেমময় ছিল তাঁর সম্পর্ক। নিজে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেও সাধনার স্তর পেরিয়ে শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেননি তিনি এখনো। কেন, জানতে চাইলে বললেন, ‘এ বড় সহজ কাজ না। মানুষের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে ভালোবাসতি হয়, রিপুকে বশে আনতি হয়।’

সারা রাত ধরে গান করেন কুষ্টিয়ার টুনটুন বাউল, আনু শাহ, বলাই শাহ, সিদ্দিক ওস্তাদ, শেলি বাউল, লগ্না বাউল মাসুম শাহ। গাজীপুর সাধুর বাজার থেকে এসেছিলেন ঐক্যজিৎ বাউল, সোহেল খ্যাপা, ইমন ভেড়ো, ফকির লোকমান, জনি বাউলসহ অনেকে। তাঁরা গেয়ে শুনিয়েছেন লালন ফকিরের ‘মন আমার কিসের গৌরব করছ ভবে’, ‘আমি ওই চরণের দাসের যোগ্য নই’, ‘চাতক বাঁচে কেমনে’ গানগুলো।

আখড়ায় দেখা মেলে পোল্যান্ডের এক ভবঘুরে তরুণের। দু-একটি বাংলা শব্দ উচ্চারণ করে উপস্থিত এলাকাবাসীকে চমকে দিচ্ছিলেন তিনি। জানালেন, আসরটি খুব ভালো লেগেছে তাঁর। সেখানে উপস্থিত মানুষগুলো অনেক সরল। গানের সুর ও বাদ্যের বাজনাগুলো হৃদয়ের গভীর ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর। একপর্যায়ে এক বাউলের সঙ্গে গভীর আলাপে মত্ত হয়ে যান তিনি। ব্যাপারটি দেখে অন্য এক সাধক মন্তব্য করেন, দেখেন, ওরা কেউ কারও ভাষা জানে না অথচ কত কথা তাদের! যেন টেলিফোনের তারের ওপর দুই রঙের দুটি পাখি দূর আলাপনে ব্যস্ত। ভোরের দিকে মঞ্চে এক বাউলকে গেয়ে উঠতে শোনা যায় ‘হুমায়ুন সাধু আমার প্রাণের কান্ডারি’ গানটি। এ নিশ্চয়ই তাঁর বাঁধা নতুন কোনো গান।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের আসর। রোববার ভোর পর্যন্ত সেখানে গান করার কথা নরসিংদীসহ অন্য জেলা থেকে আসা শিল্পীদের। ভোরে সাধুসঙ্গ শেষ হলে আবার দেখা হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে তাঁরা ফিরে যাবেন যে যাঁর ডেরায়। এখন থেকে ওই আখড়ায় তিনটি সাধুসঙ্গ হবে। একটি তিরোধানের ৪০তম দিনে লালন-স্মরণ, দ্বিতীয়টি হুমায়ুন সাধুর মায়ের তিরোধান দিবস ও শেষটি সাধুর তিরোধানের দিন—২৬ মার্চ।