ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করবে আজ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মূল নির্মাণ পর্বে প্রবেশ করছে আজ বৃহস্পতিবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে এই পর্বের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি নতুন পথযাত্রা শুরু হচ্ছে। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তব হয়ে উঠছে। 

মূল নির্মাণ পর্বের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন থেকেই ঘড়ির কাঁটা চলতে শুরু করবে। অর্থাৎ, প্রকল্প শেষ হওয়ার ক্ষণগণনা শুরু হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ শেষ করার জন্য ঠিকাদার কোম্পানি রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয়েক্সপোর্ট আজ থেকে ৬৬ মাস বা সাড়ে পাঁচ বছর সময় পাবে। সে অনুযায়ী ২০২৩ সালের মে-জুনে কেন্দ্রটির ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট এবং এর পরের বছর একই ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ার কথা।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ১৯৬১-৬২ সালে। তবে ২০১১ সালের ২ নভেম্বর রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তসরকার সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এই প্রকল্পের কাজ গতি পায়। তারও ছয় বছর পর আজ এই প্রকল্পের মূল নির্মাণ পর্বের কাজ শুরু হলো। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পৃথিবীর পারমাণবিক ক্লাবের ৩২ তম সদস্যদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলো। একই সঙ্গে বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে ষষ্ঠ এবং সার্কের তৃতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দেশের তালিকায় ঢুকল।

গতকাল বুধবার রূপপুরে প্রকল্প এলাকা ঘুরে এক উৎসবের আবহ দেখা গেছে। মূল নির্মাণ পর্বের উদ্বোধন উপলক্ষে প্রাঙ্গণসহ সমগ্র প্রকল্প এলাকা বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কিছু সাধারণ কাজ এবং মূল পর্ব শুরুর জন্য অপরিহার্য কিছু কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। প্রথম পর্যায়ের কাজ এখন পর্যন্ত প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে (বিএইসি) বুঝিয়েও দেওয়া হয়নি।

কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যে কাজের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল নির্মাণ পর্ব শুরু করা হয়, তাকে বলে ‘ফার্স্ট কংক্রিট পৌরিং বা এফসিপি’। কংক্রিটের যে ভিতের ওপর পরমাণু চুল্লি (রিঅ্যাক্টর) স্থাপন করা হবে, সেই ভিত তৈরির জন্য কংক্রিট ঢালাই শুরু হয় এই কাজের মাধ্যমে। কিন্তু কংক্রিট ঢালাই শুরুর আগে সেই স্থানের অনেক গভীর থেকে মাটির বিশেষ উন্নয়ন করতে হয়, যাতে ১০০ বছর ধরে ওই মাটি চলমান পরমাণু চুল্লির ভার নিরাপদে বইতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাটি উন্নয়নের সেই কাজ শেষ হয়নি।

কর্মকর্তারা জানান, রূপপুর প্রকল্পের মূল ঠিকাদার (জেনারেল কন্ট্রাক্টর) রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয়েক্সপোর্ট স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে মাটি উন্নয়নের জন্য উপঠিকাদার নিয়োগ করেছে। তারা ‘ডিপ সয়েল মিক্সিং’ নামের জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজটি করছে। তবে তা শেষ করতে আরও সময় লাগবে। রূপপুরের মাটি নদীবাহিত বেলেমাটি হওয়ায় এই কাজে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের মূল নির্মাণ পর্বের কাজ শুরুর জন্য বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি অথরিটি (বিএইআরএ) ৪ নভেম্বর বিএইসিকে যে ‘ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লাইসেন্স’ দিয়েছে, তা-ও শর্ত সাপেক্ষে দেওয়া হয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকল্প এলাকার বেলেমাটি পরমাণু চুল্লি স্থাপনের উপযোগী করে তোলা, পদ্মা পাড়ের প্রতিরক্ষা বাঁধ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিরাপদ করা, যেকোনো জরুরি অবস্থায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের (ইমারজেন্সি রেসপন্স) পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা, প্রকল্পের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রভৃতি।
বিএইসি সূত্র জানায়, এই কাজগুলো গত ৭ আগস্টের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু বর্ষা মৌসুমের কারণে সব কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। এই কাজগুলো সম্পন্ন করে আগামী মার্চ মাস নাগাদ তারা নিঃশর্ত লাইসেন্স পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলে চূড়ান্ত লাইসেন্স পেতে ছয় মাসের বেশি বিলম্ব হলেও এ জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সময় পেছাবে না।

তবে প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হিসেবে আরও এমন কিছু বিষয় আছে, যা বিএইসি কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের আওতার বাইরে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রকল্পের ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য অনুপযোগী রাস্তা ও সেতু। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রূপপুর পর্যন্ত কয়েকটি ক্রেন নিতে গিয়ে সেতুর টোল প্লাজাসহ রাস্তার অনেক স্থানে কিছু কিছু স্থাপনা ভাঙতে হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণও দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর একটি টোল প্লাজা ভাঙার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ১২ লাখ টাকা। দাউদকান্দি ও বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে ওই ক্রেন পরিবহন করতে হয়েছে একেকটি অংশ খুলে খুলে, আলাদাভাবে।

প্রকল্পের আরও ভারী মালামাল নৌপথে পরিবহনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এ জন্য আরিচা থেকে রূপপুর-সংলগ্ন হার্ডিঞ্জ সেতু পর্যন্ত নদী খনন (ক্যাপিটাল ড্রেজিং) করতে হবে। এরপর প্রতিবছর রক্ষণাবেক্ষণ খননও (মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং) চালাতে হবে। রেলপথে প্রকল্পের মালামাল পরিবহনের জন্য ঈশ্বরদী জংশন থেকে একটি লুপলাইন করে রূপপুর পর্যন্ত রেলসংযোগ নিয়ে যাওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। সেই কাজও এখন পর্যন্ত শুরু করা হয়নি। তবে ২০১৯ সালের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

এসব কাজ সম্পন্ন করতে তিন-চার বছর লাগলে ভারী মালামাল পরিবহন বিলম্বিত হবে, যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপরও। প্রকল্পের মালামাল আনার ক্ষেত্রে বন্দরেও বিলম্ব হচ্ছে। রূপপুর প্রকল্পের জন্য বন্দরে দরকার একটি আলাদা জেটি। কিন্তু তা করা অনেক ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। ঠিকাদার কোম্পানি এবং প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সূত্র জানায়, এসব বিষয় নিয়ে তারা চিন্তিত। বন্দরের ক্ষমতা এবং ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য রাস্তা ও সেতুর অনুপযোগিতার বিষয়ে প্রকল্পের মূল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়েক্সপোর্টের সঙ্গে আগে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।

এই অবস্থার মধ্যে প্রকল্পের মূল পর্বের নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে। রাশিয়ার দেওয়া প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশ সরবরাহ ঋণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে রাশিয়ার উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক (থ্রি প্লাস জেনারেশন) ‘ভিভিইআর ১২০০’ প্রযুক্তির পরমাণু চুল্লি ব্যবহার করা হবে। রাশিয়ার বাইরে এই প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুরেই প্রথম হচ্ছে।

বর্তমানে পৃথিবীর ৩১টি দেশে ৪৫০টি পারমাণবিক বিদ্যুতের ইউনিট চলমান আছে। এগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৩ লাখ ৯২ হাজার মেগাওয়াট (৩৯২ গিগাওয়াট)। এ ছাড়া বাংলাদেশ ছাড়া আরও ৬০টি ইউনিট বিভিন্ন দেশে নির্মাণাধীন রয়েছে, যার মোট ক্ষমতা প্রায় ৬০ হাজার মেগাওয়াট।