ডাকসুর দাবিতে একক লড়াই

ওয়ালিদ আশরাফ
ওয়ালিদ আশরাফ

ওয়ালিদ আশরাফ কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতা বা কর্মী নন। জাতীয় কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও তাঁর সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু তিনি চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ২৭ বছর ধরে বন্ধ থাকা ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে তিনি একা অনশন শুরু করেছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করা পর্যন্ত তিনি অনশন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন।

ত্রিশোর্ধ্ব এই যুবক অবস্থান নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্মৃতি চিরন্তন’ নামক চত্বরে। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের স্মরণে নির্মিত এই চত্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের ঠিক পাশে। গত শনিবার শুরু হয়েছিল এই অনশন। একে একে ছয় দিন পার হয়ে গেছে। এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

রাজধানীর মগবাজারের মধুবাগ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ওয়ালিদ আশরাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সন্ধ্যাকালীন স্নাতকোত্তর কোর্সের ছাত্র। ভাষা শিখছেন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। তাঁর একক এই প্রতিবাদ এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ছাত্রসংগঠনগুলো তাঁর দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে। অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীও অবস্থান নিয়েছেন তাঁর পাশে। ডাকসু নির্বাচনের স্লোগান নতুন করে লেখা হচ্ছে ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে।

স্মৃতি চিরন্তনীর প্রকাণ্ড কড়ইগাছের নিচে ছোট্ট একটি অস্থায়ী তাঁবু গেড়েছেন ওয়ালিদ আশরাফ। নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আর কম্বল নিয়ে সেখানেই কাটছে দিন-রাত। ওয়ালিদ আশরাফের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে প্রতিদিন। পাশের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী কেউ কেউ এসে আলাপও করছেন তাঁর সঙ্গে।

ওয়ালিদ আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী না হলেও আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ভাষা শিখতে গিয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা হয়। তিনি জানতে পারেন, এখানে আবাসিক হলে থাকতে হলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কৃপায় থাকতে হয়। যখন-তখন দলীয় কর্মসূচিতে জোর করে নেওয়া হয়। ক্যানটিনের খাবার নিম্নমানের। হলের কক্ষে বিছানায় ছারপোকার দৌরাত্ম্য।

ওয়ালিদ বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ীই এখানে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি থাকার কথা, যাঁরা ছাত্রদের অধিকারের কথা বলবেন।

ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ওয়ালিদ আশরাফের অনশন৷ শুক্রবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের স্মৃতি চিরন্তনে। ছবি: প্রথম আলো
ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ওয়ালিদ আশরাফের অনশন৷ শুক্রবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের স্মৃতি চিরন্তনে। ছবি: প্রথম আলো

ওয়ালিদ বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়মিত নির্বাচন হয়। এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচনও হয়। হয় না শুধু ডাকসু নির্বাচন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। তখনই তাঁর মনে হয়েছে, এভাবে আর চলতে পারে না। সবার আগে ডাকসু নির্বাচনের দরকার। তাই কোনো কিছু না ভেবে, কোনো কিছুর ধার না ধেরে একাই দাবি আদায়ে নেমে পড়েছেন।

ওয়ালিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী আসেন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। তাঁরা বলেন, হল থেকে ‘বড় ভাইয়েরা’ বের করে দেবে, এমন ভয় না থাকলে তাঁরা অনশনে শামিল হতেন। এমনকি ছাত্রলীগের অনেক নেতাও এসে তাঁকে উৎসাহ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

ওয়ালিদের অনশনের খবর গণমাধ্যমে দেখে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন আনোয়ারুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। একসময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। প্রথম আলোকে বলেন, অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি নিয়ে বসেছেন ওয়ালিদ। প্রথম দিন খবর দেখেই আসতে চেয়েছিলেন। সময় করে উঠতে পারেননি। উৎসাহ দিতেই তাঁর আসা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তৌফিক হুসাইন এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবু রায়হান খান ও অনাবিল ঘোষকে দেখা গেল ওয়ালিদ আশরাফের তাঁবুর পাশেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে। তৌফিক বললেন, ওয়ালিদ যেদিন অনশন শুরু করেছেন, সেদিনই তাঁরা সংহতি জানিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন সহজেই দেওয়া যায়। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের অনুষঙ্গ অনেক। বিভিন্ন প্রকৃতির অনুষঙ্গ এখানে, পাঁচটা অনুষঙ্গ প্রায়। সবাইকে একসঙ্গে করে তারপর ভাবতে হবে। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে নির্দেশনা দিয়েছেন, আদালতেরও নির্দেশনা আছে, সিনেটেরও পরিপূর্ণতা দরকার, নেতৃত্বও দরকার। আশা করছি সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সামনে একটা উদ্যোগ নেব।’ 

অনশনরত ওয়ালিদের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘নিরিবিলি আছে। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এটাও একটা উপায়। ’

ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। ১৯৯৮ সালে ডাকসুর কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। মাঝেমধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরপর ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর নতুন উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে স্মারকলিপি দিয়েছেন তাঁরা।

ওয়ালিদ অনশন শুরুর পর তাঁরা আবারও সোচ্চার হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর জোট প্রগতিশীল ছাত্রজোট ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবিতে রাজু ভাস্কর্যে কর্মসূচি পালন করেছে। মুখে কালো কাপড় বেঁধে মানববন্ধন করেছেন তাঁরা। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট এবং ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক ছাত্রনেতারা কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।