আগ্রহ নেই আ.লীগের, আইনি জটিলতা আছে

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচন নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। বরং জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাকে ঝামেলা মনে করছে দলটি। কারণ, রাজধানীতে হারলে জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। প্রার্থীসংকটের কারণে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বও আছে।

আবার জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে এই নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তার দায় বর্তাবে ক্ষমতাসীনদের ওপর। এতে সমালোচনার মুখে পড়ার পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়ে উঠতে পারে।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে দলটির এ মনোভাব জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, নতুন ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ার কারণে ডিএনসিসি নির্বাচন নিয়ে আইনি জটিলতা আছে। আর এ জন্য নির্বাচনটা আটকে গেলে আওয়ামী লীগ আক্ষেপ করবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশনও মনে করছে, নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ার ফলে আইনি জটিলতা হতে পারে। তবে এই জটিলতা কীভাবে নিরসন হবে, তা খুঁজে বের করা নিয়ে কোনো পক্ষই বাড়তি তৎপরতা দেখাচ্ছে না।
আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ৪ ডিসেম্বর ডিএনসিসি মেয়রের পদ শূন্য ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর ফলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) কয়েক দিন ধরেই বলছে, নির্বাচনের বিষয়ে শিগগিরই ঘোষণা আসছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে মনোনয়ন পেতে অনেকেই চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছেন। তবে দলীয় সূত্র বলছে, প্রার্থী বাছাই বা নির্বাচনের কৌশল ঠিক করার বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এখনো তৎপরতা শুরু হয়নি।
অন্যদিকে বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, তাদের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ অনেক দূর এগিয়ে আছে। তবে সরকার এই সময়
নির্বাচন দেবে কি না, এটা নিয়ে তাদেরও সন্দেহ আছে। তাই দলটি আগে থেকে বেশি তৎপরতা দেখাতে চায় না। গতকাল পর্যন্ত ডিএনসিসি নির্বাচন নিয়ে ইসিও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে।
জানতে চাইলে ইসি সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত ডিএনসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ১৭ ডিসেম্বর এ বিষয়ে ইসি বৈঠক করবে। এ জন্য কার্যপত্র তৈরি করা হচ্ছে।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ার ফলে নতুন করে শুধু মেয়র পদে নির্বাচন করতে গেলে আইনি জটিলতা হতে পারে। একই সঙ্গে নতুন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচন করতে গেলে সেটা কীভাবে হবে, কাউন্সিলরদের মেয়াদ কত বছর হবে, তা বর্তমান আইনে উল্লেখ নেই। কেউ কেউ মনে করছেন, এ-সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, মেয়র পদে উপনির্বাচনের সময় নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ভোট হলে এর মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে অবশিষ্ট সময়ের জন্য ঘোষণা করা যেতে পারে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একটা প্রজ্ঞাপন জারি করলে আইনি জটিলতাও নিরসন হবে। এখন এ বিষয়ে সরকার বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে ইসি।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ডিএনসিসির মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করেছি। এখন এর নির্বাচন নিয়ে যা করার নির্বাচন কমিশন করবে।’ নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, এসব ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয় থেকে অনেক আগেই ইসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন ইসি যা করার করবে।
জটিল এই পরিস্থিতিতেও ইসি একটা তফসিল ঘোষণার চিন্তা করছে। আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভোট গ্রহণের প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও চলছে। তবে ওই সময়টাতে এসএসসি পরীক্ষা চলবে। আবার ৩১ জানুয়ারি হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ডিএনসিসির তফসিল ঘোষণার ক্ষেত্রে এটিও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। কারণ, এ নিয়েও জটিলতা বা মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, ডিএনসিসি নির্বাচন নিয়ে দোটানায় আছে দলটি। প্রার্থীসংকটের কারণে জয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দিহান দলটির বেশির ভাগ নেতা। অভ্যন্তরীণ জরিপও জোরালো ভরসা জাগাচ্ছে না।
তা ছাড়া এই নির্বাচনের পরিবেশ, ভালো-খারাপ সবদিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যায়ন করা হবে। এর ফলাফলের একটা প্রভাব অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। ফলে হঠাৎ হাজির হওয়া এ নির্বাচন সরকারি দলকে কিছুটা ভাবনায় ফেলেছে। এখন যে প্যানেল মেয়র দায়িত্ব পালন করছেন, তিনিও আওয়ামী লীগের। ফলে নতুন করে ঝুঁকি নেওয়ার দরকার মনে করছে না সরকারি দল।
অবশ্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ভালো প্রার্থীর অভাব নেই। আনিসুল হক মেয়র থাকাকালে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। ফলে তাঁদের প্রার্থীই জয়ী হবেন এবং সে রকম যোগ্য প্রার্থীই মনোনয়ন দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করলে তাঁদের কার্যক্রম শুরু হবে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাল ভোট ও জবরদস্তির ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজধানী শহরে পুনরায় এমন নির্বাচন হলে বিরোধীরা বলার সুযোগ পাবে-এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আবার সুষ্ঠু ভোট হলে জয়ের সম্ভাবনা কতটুকু, সেই হিসাবও কষতে হচ্ছে। কারণ, বরিশাল সিটি করপোরেশনের শওকত হোসেন ও রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেও ২০১২ সালের সিটি নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন।
এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি দীর্ঘদিন প্রশাসক দিয়ে চালানোর নজির আছে। মেয়াদ পার হওয়ার পরও মামলার কারণে ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত অনেক দিন প্রশাসক দিয়ে দুই সিটি চালানো হয়।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, তফসিল ঘোষণার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছেন। এরপরই প্রার্থী বাছাই শুরু হবে। আইনি জটিলতার কারণে নির্বাচন আটকে যাওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা ইসি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত ১৬টি ইউনিয়নকে ৩৬টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করে গত জুলাই মাসের শেষের দিকে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এর ফলে ঢাকা উত্তরে ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হয়ে মোট ওয়ার্ড হয়েছে ৫৪টি। আর দক্ষিণে ১৮টি নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হয়ে মোট ওয়ার্ড হয়েছে ৭৫টি।
ইসি ও আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, মেয়রের নির্বাচন করতে গেলে নতুন ওয়ার্ডগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত কারও মনঃপূত না হলে এবং কেউ মামলা করলে নির্বাচন আটকে যেতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের ভোটারদের বঞ্চিত করলে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। কেউ জটিলতা সৃষ্টি করতে চাইলে তা করতে পারবে। এটা নিয়ে মামলা হতে পারে, নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশও আসতে পারে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে যদি এমন কিছু করে, তাহলে বিপর্যয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে, এড়ানো যাবে না। এটা কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না।