বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে নতুন মাত্রা ও চ্যালেঞ্জের বছর

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২০১৮ সাল হবে একই সঙ্গে নতুন মাত্রা সংযোজন ও নতুন চ্যালেঞ্জের বছর।

নতুন বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত দুটি নতুন ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে। এর একটি সর্বোচ্চ চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বেশি হবে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা উদ্বৃত্ত হবে।

দ্বিতীয়টি ঘটতে যাচ্ছে জ্বালানি খাতে। আশা করা যায়, এপ্রিলে দেশের জ্বালানি খাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে আমদানি করা, অপেক্ষাকৃত বেশি দামের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা প্রায় অর্ধযুগ আগের হলেও এই প্রথম এলএনজি আমদানি শুরু হতে যাচ্ছে। এই দুটি ঘটনা দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নতুন করে ঝুঁকি বাড়বে। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে তেলভিত্তিক কেন্দ্রের মাধ্যমে। আর জ্বালানির সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে এলএনজির মাধ্যমে। এই তেল এবং এলএনজি দুটিই উচ্চমূল্যের এবং আমদানি করা পণ্য, যার বাজারের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে এই পণ্যের দাম বাড়লে আমরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ব।

আরও কিছু চ্যালেঞ্জ

এর পাশাপাশি আগামী বছরটি এই খাতের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসছে। এর মধ্যে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো ওপরের দুটি ঘটনা দেশে নতুন করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর নিশ্চিত ক্ষেত্র তৈরি করবে। এর মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে কম দামের জ্বালানি ব্যবহারের যে সুযোগ এ দেশে অব্যাহত ছিল, সেই যুগের অবসান হবে।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হবে, আগামী বছর যে
 বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে তা সুষ্ঠুভাবে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থাকে উপযোগী করে গড়ে তোলা।

তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এলএনজি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান। সরকারের হিসাব অনুযায়ী এলএনজি আমদানির জন্য বছরে ৩০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হবে।

আরও কতিপয় চ্যালেঞ্জের কথা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। যেমন চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট ঘাটতি সত্ত্বেও দেশে গ্যাসের চুরি ও অপচয় ব্যাপক। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের (২০১৬) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ সাল থেকে প্রতিবছর শিল্প খাতে গ্যাসের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। অথচ ২০১০ সালের জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষ ক্ষেত্র বিবেচনায় জরুরি প্রয়োজনে নতুন সংযোগ দেওয়ার জন্য যে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ছিল বা এখনো আছে, সেই কমিটি গত ৬-৭ বছরে সর্বমোট হাজারখানেক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নতুন সংযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু তার অর্ধেক প্রতিষ্ঠানকেও এখন পর্যন্ত গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়নি।

একইভাবে ২০১০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত আবাসিক খাতেও অধিকাংশ সময় নতুন গ্যাস-সংযোগ প্রদান বন্ধ ছিল এবং আছে। তা সত্ত্বেও শিল্প খাতের মতো আবাসিক খাতেও গ্যাসের ব্যবহার প্রতিবছর বেড়ে আগের ১২ শতাংশ থেকে ১৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার বা চুরি অব্যাহত ছিল এবং আছে।

তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তিন হাজার মেগাওয়াট তেলভিত্তিক কেন্দ্র বেসরকারি খাতে স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াটের কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে। এগুলো ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে উৎপাদনে আসবে। এ ছাড়া কিছু কেন্দ্র নির্মাণাধীন আছে। সেগুলোও উৎপাদনে আসবে। যেমন ভেড়ামারা ৪৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিতে ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে।

২০১০-১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ছয়বার ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রধান কারণ ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিকসহ তেলচালিত বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি বহুমুখীকরণের যে নীতি অনুসরণ করছে তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অপেক্ষাকৃত বেশি দামের ডিজেল এবং ফার্নেস তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর একটিও বাস্তবায়িত না হওয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। নতুন এই কেন্দ্রগুলো স্থাপনের ফলে তা আরও অনেকটা বাড়বে। তাই দাম বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।

সরকারের পরিকল্পনা ও পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী বছর দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হবে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা হবে ১৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আগামী বছর প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৪৯ মেগাওয়াট সরকারি খাতে এবং অবশিষ্ট প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট হবে বেসরকারি খাতে।

বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা ১৩ হাজার ৬২১ মেগাওয়াট (২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ছাড়া)। সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৫০৭ মেগাওয়াট (১৮ অক্টোবর ২০১৭)। সরকার বলছে, আগামী বছর সর্বোচ্চ চাহিদা হবে ১৪ হাজার মেগাওয়াট।

এলএনজি আমদানির বছর

আগামী বছর এলএনজি আমদানি শুরু হলে দেশের জ্বালানি খাতের চিত্র অনেকটাই পাল্টে যাবে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছর এপ্রিলে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের সমপরিমাণ এবং নভেম্বর থেকে দৈনিক আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি শুরু হলে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে আসবে।

পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, আগামী বছরের শেষ নাগাদ দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা হবে ৩ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যার প্রায় সমানই হবে সরবরাহক্ষমতা। বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর সবটাই দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে উত্তোলিত গ্যাস।

এলএনজি আমদানির পাশাপাশি আগামী বছর সরকারকে জ্বালানি তেল আমদানিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়াতে হবে। অবশ্য এই খাতে সরকার একটি সুবিধাজনক অবস্থান করে নিয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় এবং দেশের বাজারে সেই তুলনায় দাম না কমানোয় এই খাতে সরকার বিপুল মুনাফা করছে। তাই জ্বালানি তেলের আমদানি বৃদ্ধি সরকারের জন্য মাথাব্যথার কোনো বিষয় নয়। তবে এলএনজি আমদানির ফলে গ্যাসের সম্ভাব্য দাম বৃদ্ধি দেশের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন করে রেখেছে।