দৃষ্টিজয়ীদের স্পর্শ

>

যাঁদের চোখে আলো নেই, তাঁদেরও তো ছড়া-গল্প-উপন্যাস পড়তে ইচ্ছা করে। বই পড়ে ভাসতে ইচ্ছা করে কল্পনার রাজ্যে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের বাইরে, তঁাদের উপযোগী বাংলা ভাষার বই কোথায়? এগিয়ে এল স্পর্শ। মনের আলোয় বইপড়ুয়াদের জন্য ব্রেইল সংস্করণে সাহিত্যের বই প্রকাশ করল। এ বছর এক দশক পূর্ণ করছে আলো ছড়ানো সংগঠনটি। স্পর্শের কথাই থাকছে প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে।

কথা বলতে বলতেই চোখজোড়া ভিজে উঠল সারওয়াতের। তবে অবয়বে বিষাদের ছায়া নেই। অসম্ভব কিছু পাওয়ার যে তৃপ্তি, মৃদু হাসির রেখায় সেটাই যেন ফুটে উঠল। তার মা সাবিনা ইয়াসমিন বলে চলেন, ‘ঈদের দিনও এত সকালে ও ওঠে না। সেদিন উঠেছিল। কী যে উচ্ছ্বাস মেয়েটার—বইমেলায় ওর জন্যও স্টল হয়েছে, বই আছে। মেলায় নিয়ে গেলাম। বইয়ে হাত বোলাল। বিড়বিড় করে পড়ল। মনে হলো, ওর খুব প্রিয় কিছু হাতে পেয়েছে। মেয়ের আনন্দ দেখে সেদিন কান্না আটকাতে পারিনি।’

খুদে শিক্ষার্থীদের রিস্টব্যান্ড পরিয়ে দিচ্ছেন অভিনেত্রী ও নির্দেশক ত্রপা মজুমদার, ডানে নাজিয়া জাবীন । ছবি: কবির হোসেন
খুদে শিক্ষার্থীদের রিস্টব্যান্ড পরিয়ে দিচ্ছেন অভিনেত্রী ও নির্দেশক ত্রপা মজুমদার, ডানে নাজিয়া জাবীন । ছবি: কবির হোসেন

সাবিনা ইয়াসমিন বলছিলেন ২০১১ সালের কথা। তাঁর মেয়ে সারওয়াত হোসেন তখন নিতান্তই ছোট। জন্ম থেকে চোখের আলোহীন মেয়েটি এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। তিনি বলছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই একদম বইয়ের পোকা। শুধু গল্প শুনতে চাইত। কতক্ষণ আর বই পড়ে গল্প শোনানো যায়। একসময় পড়তে পড়তে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম।’

সারওয়াত এখন নিজেই পছন্দের ছড়া-গল্প-উপন্যাস পড়ে। তাদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে, বাংলা ভাষায় সাহিত্যের বই পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ বাংলা ভাষার খ্যাতিমান লেখকদের বইসহ বিভিন্ন লেখকের ৪৭টি বই প্রকাশ করেছে স্পর্শ। এ বছর প্রকাশ করবে আরও ১৪টি।

গান করছে সাদিয়া ইসলাম
গান করছে সাদিয়া ইসলাম

বই প্রকাশ ছাড়াও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের এগিয়ে নিতে নানা কাজ করছে তারা। আলো ছড়ানো সংগঠনটি এ বছর এক দশক পূর্ণ করছে। এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংগঠনটি। ২ জানুয়ারি বিকেলের বৈঠকি আয়োজনটাও ছিল মহড়া পর্ব। ঢাকার গুলশানে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার প্রধান উদ্যোক্তা নাজিয়া জাবীনের বাসাতেই সে আয়োজন ছিল।

তাঁর সঙ্গে কথা বলতেই সেদিন যাওয়া। বাড়িতে আরও পাওয়া গেল ফারহিম আনজুম, রিপা তাবাসাসুম, সোরাইয়া হোসেন, মার্জিনা বেগম, অনিকা ইবনাতদের। তাঁদের কেউ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়েন, কেউবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। প্রত্যেকেই মনের আলোয় এগিয়ে চলেছেন দৃপ্ত পায়ে। অনেকে ভালো গান করেন, কেউ তুখোড় বিতার্কিক, কেউবা বক্তা।

২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্পর্শের স্টলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্পর্শের স্টলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

তাঁদের সঙ্গে করে এনেছেন মায়েরা। প্রত্যেকের কুশল বিনিময় দেখে মনে হলো, সবাই যেন একই পরিবারের। খুব আপনজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী নাহিয়ান বুশরা বললেন, ‘আমরা সবাই মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন স্কুলের। তাই সবাই সবার পরিচিত। তা ছাড়া আমাদের নিয়ে কোনো আয়োজন হলেই সবার সাক্ষাৎ হয়।’

তাঁদের সঙ্গে আলাপের ফাঁকেই স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার প্রধান উদ্যোক্তা নাজিয়া জাবীনের কাছে শুনতে চেয়েছিলাম সংগঠনটির এগিয়ে চলার কথা।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল স্পর্শ
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল স্পর্শ

সবার জন্য বই

 ১৯৯০ সালের কথা। এক দুর্ঘটনায় নাজিয়া জাবীনের পরিবারের একজন দৃষ্টিশক্তি হারান। খুব কাছ থেকে মানুষটার দুঃখ-কষ্ট দেখেন। তখন থেকেই তাঁকে খুব ভাবাত কিছু করার। তিনি বললেন, ‘আমি ১৯৯৬ সাল থেকেই প্রেরণা নামে একটি সংগঠনের হয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নানা ধরনের কাজ করতাম। সব সময় চেষ্টা করেছি কিছু করার।’

সেই কিছু করার চিন্তাটা নতুন মাত্রা পায় ২০০২ সালে। তাঁর ছড়ার বই ছড়ার তালে মনটা দোলে প্রকাশের পরই সেটা মাথায় চাপল—বইটা শুধু দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষই কেন পড়ার সুযোগ পাবেন, অন্যদের জন্যও তো এই সুযোগ করে দেওয়া উচিত।

২০০৮ সালে সে ভাবনাটাই ডালপালা মেলে জন্ম নিল স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। পরের বছর নিজের বইটা দিয়েই শুরু করলেন ব্রেইল সংস্করণে বই প্রকাশ। বই পৌঁছে দিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুলে। বিনা মূল্যে দেওয়া হলো তাঁদের হাতেও। পাঠ্যবইয়ের বাইরে ছড়ার বই পেয়ে তাঁরা তো মহাখুশি। তাঁদের আনন্দ শক্তি জোগাল নাজিয়া জাবীনের মনে।

পরিচিতজনদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। অনেকে সহায়তার হাত বাড়ালেন। সে অনুপ্রেরণায় ভর করেই একে একে সাতটি বই প্রকাশ করলেন। তখন ২০১১ সাল, চিন্তা করেন আরও বড় পরিসরে কাজটি এগিয়ে নেওয়ার।

২০১৭ সালের বইমেলায় স্পর্শের স্টল
২০১৭ সালের বইমেলায় স্পর্শের স্টল

স্পর্শের এগিয়ে চলা

২০১১ সালে প্রথমবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথম স্টল বরাদ্দ পায় স্পর্শ। একটি স্টল পেতে শুরুতে যে ধকল পোহাতে হয়েছিল, এখন তা অনেকটাই সহজ। বাংলা একাডেমি নিজ উদ্যোগেই এখন স্পর্শের পাশে থাকে। এগিয়ে এসেছে আরও প্রতিষ্ঠান। স্পর্শের শুরুর অভিজ্ঞতা শোনালেন একটি শিশু পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও স্পর্শের সংগঠক আহসান হাবিব, ‘আমাদের শুরুটা সহজ ছিল না। স্টলে নানাজন নানা মন্তব্য করতেন। অনেকে এসে বই ধরে জিজ্ঞেস করতেন, এগুলো কী? একটু পড়ে শোনান তো! সেসব বাধা অতিক্রম করেই আজকের স্পর্শ।’

এখন বইমেলায় দুটি স্টল বরাদ্দ পায় স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। যাঁদের বই তাঁরা এসে আনন্দে মেতে থাকেন। স্টলে স্বেচ্ছাসেবকও তাঁরা। নাজিয়া জাবীন বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে কতটুকুবা করব। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বই পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কাজে সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত। ব্রেইল বই প্রকাশ করলে বিক্রি বাড়বে, প্রকাশকেরাও আগ্রহী হবেন। তাই উদ্যোগটা জরুরি।’

বই পড়ছেন তিনজন
বই পড়ছেন তিনজন

কেক কেটে বর্ষবরণ

ঘরোয়া আয়োজনের এক ফাঁকে চলে এলেন অভিনেত্রী ও নির্দেশক ত্রপা মজুমদার। স্পর্শের ১০ বছর পূর্তির সাংস্কৃতিক আয়োজন কীভাবে-কী হবে তারই পরামর্শ দেবেন তিনি। সে অনুষ্ঠানের জন্য বানানো হয়েছে রিস্টব্যান্ড। ত্রপা মজুমদার দুজনের হাতে পরিয়ে দিলেন। ‘মানুষ দৃষ্টিহীন বলেই অন্ধ নয়, মানুষ প্রজ্ঞাহীন বলেই অন্ধ’ কবজিবন্ধির গায়ে লেখা অমৃত বচনটি তিনি বুঝিয়ে বললেন দুজনকে। চেয়ারে বসতেই অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার বললেন, ‘স্পর্শের সঙ্গে আমার আগে কাজ করা হয়ে ওঠেনি। তবে সবই জানি। আমার মায়েরও (ফেরদৌসী মজুমদার) দুটি বই তারা প্রকাশ করেছে।’

এরপরই কেক কেটে বরণ করা হলো ইংরেজি নববর্ষকে। খাওয়া হলো শীতের পিঠা। তখন বিদায়বেলা। পোশাক বিতরণ আর সাংস্কৃতিক আয়োজনের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন স্পর্শের কর্মীরা। এরই ফাঁকেই শুরু হলো গানের তালিম। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া সাদিয়া ইসলামের ছোট আঙুল নিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হলো হারমোনিয়ামে রিডে। সে সুর তুলল—আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...।

আমরা সে সুরের পরশ ছুঁয়ে বিদায় নিলাম।

আজ ‘আমাদের কথা’

স্পর্শের ১০ বছরের পথচলার অনেক ঘটনা নিয়েই এ আয়োজন। কথা বলবেন সংগঠনের পেছনের মানুষেরা। গুটি গুটি পায়ে এগোনোর কথা বলবেন স্পর্শের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা। ১০ বছর পূর্তি আয়োজনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আমাদের কথা’।

বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠানটি হবে আজ শনিবার বেলা সাড়ে তিনটায়। অনুষ্ঠানে থাকবে দৃষ্টিজয়ী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, দাবা-সংগীত-বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণী, ১০টি নতুন ব্রেইল বইয়ের মোড়ক উন্মোচনসহ নানা আয়োজন।