নির্যাতিত ৩২৪ নারী শ্রমিক সৌদি থেকে ফিরলেন

নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে ৩২৪ নারী গৃহশ্রমিক দেশে ফিরেছেন। সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের ৮ জানুয়ারি থেকে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এই নারীদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাঁদের অনেকেই তিন মাস পর্যন্ত সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফ হোমে ছিলেন।

ফেরার অপেক্ষায় আরও ৭৫ জন নারী বর্তমানে সেফ হোমে আছেন।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গৃহ খাতে কর্মী নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। অবশ্য যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশ মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রেখেছে। অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট সংসদীয় ককাস বলেছে, সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সির দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি না বাড়ালে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে না। 

সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য বলছে, গত বছর ১৮টি দেশে যাওয়া নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল এক লাখের বেশি। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে যান ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের এক চিঠিতে জানানো হয়, গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে গৃহকর্মীদের আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে সেফ হোমে গৃহকর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬৯ জনে। সেফ হোমের অবস্থা অসহনীয় হয়ে ওঠায় রিয়াদের কাউন্সেলর (শ্রম) বিষয়টি নিয়ে সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মিনিস্টারের সঙ্গে ৪ জানুয়ারি বৈঠকে বসেন। ডেপুটি মিনিস্টার তাঁর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয় করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার নির্দেশ দেন। গৃহকর্মীদের এক্সিট ভিসা সংগ্রহ করে ৮ জানুয়ারি থেকে গৃহকর্মীদের দেশে পাঠানো হবে বলে জানানো হয় চিঠিতে।

যাঁরা ফিরলেন
দেশে ফেরত আসা ১৮ নারী শ্রমিককে বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরতে সহায়তা করেছে বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন। এ তথ্য জানিয়ে সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি শেখ রুমানা বলেন, এই নারীদের অনেকেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকেই ঠিকমতো খাবার পাননি। মারধরের শিকার হয়েছেন।
ফেরত আসা একাধিক নারী বলেছেন, বিদেশ যাওয়ার আগে পুরো এক মাস না পেলেও কিছুদিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু খুব বেশি জানতে পারেননি। একজন বললেন, ‘প্রশিক্ষণের সময় বলছে বিপদ দেখলে বাঁচনের চেষ্টা করবা। বাসার মালিক সুযোগ পাইলেই আমার সঙ্গে খারাপ কাজ করত। মালিকের বউরে কইলে বউ আমারে পিটাইয়্যা হাত ভাইঙা দেয়। তারপর আমারে আরেক জায়গায় বিক্রি কইরা দেয়। তখন ওই জায়গা থেকে বাঁচনের জন্য পালাই।’
ময়মনসিংহের এক নারী শ্রমিক ফিরেছেন ৯ জানুয়ারি। ১৬ জানুয়ারি মুঠোফোনে ফোন দিলে তাঁর স্বামী ধরেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই নামে এহন আর কেউ নাই। ও মইরা গেছে। বিমানবন্দর থেইক্যা ওর লাশ আনছি।’
খানিক পরে ওই নারী নিজেই ফোন দিয়ে কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে সেফ হোমে আশ্রয় নেওয়ার পর তিন মাস ছিলেন সেখানে। সাড়ে চার মাসের বেতন ছাড়াই তাঁকে দেশে ফিরতে হয়েছে। অথচ বিদেশে যাওয়া এবং আসা বাবদ খরচ হয়ে গেছে প্রায় এক লাখ টাকা। এই নারী জানালেন, একবার নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাসার ছাদে গিয়ে চিৎকার করেছিলেন। এই অপরাধে বাড়ির মালিক এমন মার দেয় যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ
গত বছরের ২২ থেকে ২৭ এপ্রিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল সৌদি আরবে যায়। প্রতিনিধিদলের সুপারিশে বিদেশে পাঠানোর আগে নারীদের কমপক্ষে এক মাস প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং চুক্তির শর্ত সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া বিএমইটি থেকে ইস্যু করা স্মার্টকার্ডে বাংলাদেশি ও সৌদি রিক্রুটিং এজেন্সি এবং সৌদি নিয়োগকর্তার বিস্তারিত ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর রাখা, নারী গৃহকর্মীদের পাঠানোর আগে সব তথ্য সম্পর্কে দূতাবাস/কনস্যুলেটকে অবহিত করা এবং গৃহকর্মীদের যেকোনো সমস্যায় দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে দায়বদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
তবে এই সুপারিশের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

সচিব বললেন
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নারী গৃহশ্রমিকদের ফিরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তিতেই বলা আছে, নির্যাতনের শিকার হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। কিন্তু বিপদে পড়লে নারীরা দূতাবাসের সাহায্য নেন না। তাঁরা পালিয়ে সেফ হোম বা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন। তখন মালিকপক্ষ উল্টো ওই নারীর বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। দেশে ফেরার পরও রিক্রুটিং এজেন্সি বা দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন না।
নির্যাতন প্রসঙ্গে তাঁর কথা, ‘আমরা চিন্তা করছি বলেই তো ওরা দেশে ফিরতে পারছে। এই নারীদের বেশির ভাগেরই পাসপোর্ট সঙ্গে থাকে না। সৌদি আরব সরকারের অনুমতি ছাড়া দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না।’

প্রতিকার
নির্যাতন বন্ধে সরকারের ভূমিকা প্রধান বলে মনে করেন প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট-ওয়্যারবির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক। অপরদিকে অভিবাসী ও উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় ককাসের চেয়ারম্যান ইসরাফিল আলম মনে করেন, দালালদের আইনের আওতা এনে জবাবদিহি করা সম্ভব হলে নির্যাতনের মাত্রা কমতে পারে।