নিবন্ধন বিভাগ পরিদপ্তর থেকে অধিদপ্তর

২০০ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা সরকারের রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) বিভাগ বহু আগে থেকেই ঘুষ ও দুর্নীতির সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় দুর্নামের তকমা তাদেরও বহন করতে হচ্ছে। তবে মন্ত্রণালয় নিরবচ্ছিন্নভাবে তকমাটি বহন করে নিজেদের আর জর্জরিত করতে রাজি নয়। তারা প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে নিবন্ধন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়েছে। গত ২ জানুয়ারি এ বিষয়ে গেজেট জারি করা হয়েছে। সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি কমাতে এবং প্রতিষ্ঠানটির কাজে গতি আনতে জন্য ১৭১ জন সাবরেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে মানুষের মর্যাদার বিষয়টি সম্পৃক্ত। নিবন্ধন বিভাগ পরিদপ্তর থাকা অবস্থায় এর কর্মকর্তারা মর্যাদা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তাই এটিকে অধিদপ্তরে রূপান্তর করা হয়েছে। আমরা আশা করি, প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বাড়ার কারণে এই বিভাগের কর্মকর্তাদের কাজে গতি আসবে এবং সেবার মান বাড়বে। জায়গা-জমি বা ঘরবাড়ি নিবন্ধন করতে আসা মানুষের হয়রানি লাঘব হবে।’

নিবন্ধন বিভাগের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৭৮১ সালে। ১৭৯৩ সালে বেঙ্গল রেগুলেশনের মাধ্যমে ঢাকায় প্রথম রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯০৮ সালে উপমহাদেশের রেজিস্ট্রেশনের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়। এর পরের শতাধিক বছরে নিবন্ধন বিভাগ সুনাম যতটা অর্জন করেছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অর্জন করেছে দুর্নাম। অভিযোগ আছে, সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে ঘুষ না দিয়ে সচরাচর জমিজমা নিবন্ধন করা সম্ভব নয়।

নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, মূলত প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছিল। নতুন কাঠামো দাঁড়িয়ে গেলে দুর্নীতি ও অনিয়ম বহুলাংশে কমে যাবে।

দলিল চুরি বন্ধে সিসি ক্যামেরা

ঢাকার রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে ১৭৯৪ সাল থেকে দলিল সংরক্ষিত আছে। অতীতে অসংখ্যবার এখানকার মহাফেজখানা থেকে বালাম বই চুরি ও দলিল নষ্ট করার নজির আছে। যে কারণে একজনের জমি অন্যজনের নামে দলিল করার অনেক ঘটনা ঘটে।

সরেজমিনে রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে ঢাকার মহাফেজখানায় সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আছে একটি হেল্প ডেস্ক। সেখানে গিয়ে যে কোনো গ্রাহক তথ্যসেবা পেতে পারেন।

এ বিষয়ে ঢাকার জেলা রেজিস্ট্রার দ্বীপক কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর হলো ঢাকার মহাফেজখানায় সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এরপর থেকে দলিল তছরুপের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। হেল্প ডেস্ক থাকার কারণে মানুষের হয়রানি যথেষ্ট কমেছে। অতীতে সাধারণ মানুষ এখানে কোথায় কার কাছে যাবে, তা জানতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ত। এখন আর সেটা হচ্ছে না। নকলনবিশেরা কাজে যোগ দেওয়ায় দলিল লেখা এবং সরবরাহের হারও বেড়েছে।


ভোক্তা হয়রানির নেপথ্যে

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কেউ দলিল নিতে চাইলে তাকে প্রতি পৃষ্ঠার ৪০ টাকা হারে ফি দিতে হয়। এর মধ্যে সরকারের ১৬ টাকা এবং নকলনবিশের ২৪ টাকা। তবে শুরুতে পুরো টাকাটাই সরকারি কোষাগারে জমা হয়। পরে নকলনবিশদের পারিশ্রমিক বা ভাতা দেওয়ার জন্য সরকার থেকে আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এই টাকা কখনোই সময়মতো বরাদ্দ হয় না। যে কারণে নকলনবিশদের দিনের পর দিন পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ করতে হয়।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সময়মতো বরাদ্দ না পাওয়ায় দুই বছর ধরে দেশের ১৫ হাজার নকলনবিশ ভাতা পাচ্ছিল না। তাঁরা ভাতা আদায়ের জন্য কর্মবিরতি দিয়ে আন্দোলনে নামেন। যে কারণে জমতে থাকে দলিলের জট। দলিল জটের আরও একটি অন্যতম কারণ সময়মতো বালাম বই ছাপা না হওয়া। নিবন্ধন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৯১ লাখ দলিল অলিখিত আছে। এসব দলিল বাবদ গ্রাহকেরা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছেন ২১৮ কোটি টাকা। অথচ এখনো তাঁরা হাতে দলিল পাননি।

তবে সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয় থেকে দৌড়ঝাঁপ করে নকলনবিশদের বকেয়া পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দুই দফায় ৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দ আদায় করেছে। এরপর নকলনবিশেরা আন্দোলন বন্ধ করে কাজে মনোযোগ দেয়। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব উদ্যোগ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ লাখ ৩৫ হাজার বালাম ছাপা হয়েছে।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এখন থেকে প্রতি পৃষ্ঠা দলিল লেখা বাবদ নকলনবিশদের ২৪ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না করে সরাসরি তাদের দিয়ে দেওয়া হবে। সে জন্য বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে। আরও জানা যায়, দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন উপজেলায় শতাধিক সাব–রেজিস্ট্রার পদ খালি ছিল। তবে সম্প্রতি বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্যদের মধ্যে যাঁদের ক্যাডার পদে পদায়ন করা সম্ভব হয়নি, তাঁদের মধ্য থেকে ১৭১ জনকে সাব-রেজিস্ট্রার (নন–ক্যাডার) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯৪টি সাব–রেজিস্ট্রি অফিস ও ১৪টি জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের জন্য ভবন নির্মিত হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ৫ শতাধিক সাব ও জেলা অফিস নির্মিত হবে। বর্তমানে সারা দেশে ৪৯৭টি পদের বিপরীতে ৪৬৭ জন সাব–রেজিস্ট্রার আছে।

আইনমন্ত্রী জানান, নিবন্ধন অধিদপ্তরের রুলস অব বিজনেসে বিভাগীয় শহরে ইউনিট খোলার সুযোগ রাখা হবে। তাতে কাজের মান ও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।