রানি লাগবে, রানি!

‌লিচুবাগা‌নে মৌমা‌ছি চাষ করেন মাসুদ রানা। সেটি পরীক্ষা করে দেখছেন তিনি। সম্প্রতি   পাবনার ভাঙ্গুড়া উপ‌জেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
‌লিচুবাগা‌নে মৌমা‌ছি চাষ করেন মাসুদ রানা। সেটি পরীক্ষা করে দেখছেন তিনি। সম্প্রতি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপ‌জেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

মৌচাক মানেই এক রানির রাজত্ব। রানি যেখানে বসে সেখানেই মৌসেনারা তাকে ঘিরে রাখে। এমনকি আকাশে উড়লেও। যত রানি তত মৌচাক। তত মধু। রানির এই প্রভাব দেখে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামের মৌচাষি মাসুদ রানা মধুর পাশাপাশি রানি মৌমাছি উৎপাদন শুরু করেছেন। তিনি বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ দেশের বিভিন্ন মৌচাষির কাছে রানি সরবরাহ করে থাকেন। এই কাজ করে তিনি জায়গাজমি কিনেছেন। পাকা বাড়িঘরও করেছেন। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর ছোট ভাই রাজীব হোসেন।
প্রাকৃতিক উপায়ে ডিম ফুটে বের হতে একটি রানি মৌমাছির সময় লাগে ১৫-১৬ দিন। কৃত্রিম উপায়ে করলে ১১ দিনেই হয়। এই পদ্ধতিকে ‘গ্রাফটিং’ বলে। এতে করে অল্প সময়ে বেশি রানি উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়া কৃত্রিম উপায়ে করলে রানি বড় ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। তার প্রজননক্ষমতা বেশি হয়।
একটি মৌচাকে একটিমাত্র রানি, কিছু পুরুষ ও একদল শ্রমিক মৌমাছি থাকে। একটি রানি, কিছু পুরুষ, একদল শ্রমিকসহ একটি বড় মৌবাক্স বিক্রি হয় ৭ হাজার টাকায়। ছোট বাক্সগুলো ৪ হাজার ৩০০ টাকায়।
বর্তমানে মাসুদ রানার ১৫০টি মৌবাক্স রয়েছে। এখান থেকে প্রতিনিয়ত রানির সংখ্যা বাড়ানোর কাজ চলছে। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত এই মৌবাক্স নিয়ে তাঁরা রাজশাহী থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান।
নভেম্বর থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সরিষাখেতের পাশে তাঁবু খাটিয়ে থাকেন। এরপর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কালিজিরা, ধনিয়া, খেসারি ও রায়খেতের পাশে, মার্চ মাস লিচুবাগানে আর
এপ্রিল ও মে দুই মাস সুন্দরবনে কাটান।
সরিষার মৌসুমে ৭ থেকে ১০ দিন পর, কালিজিরার সময় মাসে একবার, লিচুর মৌসুমে সাত দিনে একবার আর সুন্দরবনে ১৫ দিন পরপর মধু আহরণ করা যায়।
কয়েক দিন আগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাসুদ রানা ও রাজীব হোসেন পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে কালিজিরার মাঠে রয়েছেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই গ্রামে গিয়ে মাসুদ রানার দেখা পাওয়া যায়। তাঁরা কালিজিরার খেত থেকে বাক্সগুলো সরিয়ে গ্রামের ইমদাদুল হকের লিচুবাগানে আনছিলেন।

গোড়ার কথা
মাসুদ রানার বাবার নাম আব্দুর রহমান। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন। বেতন কম ছিল। সে জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসেন। ২০০১ সালের দিকে তিনি এই মৌমাছি পালন শুরু করেছিলেন। বাবার হাত ধরেই তাঁর দুই ছেলে মৌচাষে উৎসাহী হন। পুঁজি কম থাকায় প্রথম দিকে তাঁরা বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারেননি। আব্দুর রহমান দুই ছেলেকে টাঙ্গাইলের এক খামারির কাছ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসেন। চার বছর আগে আব্দুর রহমান মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর দুই ছেলে তাঁর কাজকে পুরোপুরি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁরা খবর পান পাবনার ভাঙ্গুড়ার এক খামারির কাছে উন্নত জাতের আফ্রিকান ‘মেলিফিরা’ মৌমাছি আছে। তাঁরা একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ৭০ হাজার টাকায় ওই জাতের ১০টি মৌবাক্স কেনেন। 

মৌবাক্স হচ্ছে কৃত্রিম উপায়ে মৌমাছি চাষে ব্যবহৃত এমন বিশেষ ধরনের বাক্স, যার ভেতরে মৌমাছি মৌচাক তৈরি করে। দুই ভাই বাণিজ্যিকভাবে মধু ও রানি মাছি উৎপাদন শুরু করেন এসব মৌবাক্সে।
এখন তাঁরা প্রতি মৌসুমে গড়ে প্রায় ১০০ মণ মধু আহরণ করছেন। রানি মৌমাছি উৎপাদন করছেন প্রায় ১৫০টি। তাঁরা ছোট বাক্সগুলো ৪ হাজার ৩০০ টাকায় এবং বড় বাক্সগুলো ৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। মধু বিক্রি করেন একটি হারবাল কোম্পানির কাছে। ছোট বাক্স তৈরি করতে খরচ পড়ে ২৫০ টাকা এবং বড় বাক্সের খরচ পড়ে ৪০০ টাকা।
বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মধু এখন সারা বিশ্বে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা। কৃত্রিম মধু তৈরির গবেষণার পেছনে লক্ষ কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু আজও সেটা করা সম্ভব হয়নি। তবে কৃত্রিম উপায়ে মৌমাছির চাষে সাফল্য পাওয়া গেছে। এ নিয়ে এখন বাংলাদেশে নানান গবেষণা হচ্ছে। এখানে মৌমাছির চাষ বাড়ছে। এটা বাড়তেই থাকবে। কেননা মধুর স্বাস্থ্য গুণাগুণ সম্পর্কে সবাই সচেতন হতে শুরু করেছে।
মৌমাছির রাজ্যের নিয়মকানুন
দুই ভাই প্রশিক্ষণ থেকে জেনেছেন মৌমাছির জীবনচক্রের মজার কাহিনি। রানি আকারে সবার চেয়ে বড়। তার গায়ের রং আলাদা। পুরুষ মৌমাছিরা তার চেয়ে ছোট। সেগুলোর গায়ের রং আলাদা। আকারে সবচেয়ে ছোট শ্রমিক। তাদেরও গায়ের রং আলাদা। দেখেই চেনা যায়। একটি মৌচাকে চলে একটি রানির শাসন। একের বেশি রানি জন্মালে শ্রমিকেরা অন্যদের হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলে। শ্রমিকেরা মধু আহরণ, খাদ্য জোগাড়, সন্তান প্রতিপালন, ডিম দেওয়ার প্রকোষ্ঠ তৈরি ও রানির পাহারায় থাকার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে। তারা বাক্সের মুখে পাহারায় থাকে। অন্য বাক্সের মৌমাছি সেখানে ঢোকার চেষ্টা করলে পাহারাদার শ্রমিকেরা তাকে হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলে। পুরুষ মাছিরা প্রজননপ্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। আর অলস সময় কাটায়। মিলনের সময় রানি আকাশে ওড়ে। শ্রমিকেরা চারদিকে পাহারায় থাকে, কারণ রানি আকারে বড় হয় তাকে পাখিতে ধরে খেয়ে ফেলতে পারে। একজন পুরুষ মাছি শুধু মিলনের সুযোগ পায়। তারপর সে মারা যায়।
মাছির এই জীবনচক্র নিয়ে গবেষণা থেকে কৃত্রিম উপায়ে রানি তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। মাসুদ রানা ও রাজীব নিজেরাই এখন এটা করতে পারে।
গত বছর তাঁরা পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) একটি প্রকল্পে ৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকায় ১১০টি ছোট মৌবাক্স সরবরাহ করেছিলেন। এর মধ্যস্থতা করেছিলেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা বেগম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাসদু রানার মৌচাষ নিয়ে তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এটা দেখে বিনার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাসরিন আক্তার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সরিষার খেতে মৌমাছি দিয়ে পরাগায়ন করে সরিষার উৎপাদন ২৫ শতাংশ বাড়ানো-সংক্রান্ত একটা গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বিনা। ওই প্রকল্পের জন্য তাঁদের মৌবাক্সের প্রয়োজন পড়েছিল।
সাবিনা বেগম বলেন, ওই গবেষণায় সরিষার ফলন বাড়ার ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়েছে। তারপর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরিষার খেতের পাশে মৌবাক্স রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় এবার ৩৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছিল। এ জন্য তাদের জেলা কার্যালয় থেকে ১২টি মৌবাক্স রাখতে বলা হয়েছিল। যে উপজেলায় বেশি জমিতে সরিষা চাষ হয়েছিল, সেখানে বেশি বাক্স রাখতে হয়েছিল।
মাসুদ রানার বয়স এখন প্রায় ৩৩ বছর। স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে পরীক্ষা দিতে পারেননি। ছোট ভাই রাজীব হোসেন (৩০) এইচএসসি পাস করে এখন ‘লাইসেন্সেস হোমিওপ্যাথিক প্যারামেডিকেল প্র্যাকটিশনার’ কোর্সে পড়াশোনা করছেন।