হাজিরা দিয়েই মজুরি নেন তাঁরা

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে যতজন স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত, তার ছয় গুণের বেশি দৈনিক হাজিরাভিত্তিক (মাস্টাররোল) কর্মচারী আছেন। কাগজে-কলমে বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাঁদের বেশির ভাগেরই কোনো কাজ নেই। সকালে হাজিরা দিয়েই তাঁরা চলে যান। অন্যের মাধ্যমেও হাজিরা দেন কেউ কেউ। রাজনৈতিক বিবেচনায় ও বিভিন্ন মহলের চাপে নিয়োগ পাওয়া এই কর্মচারীদের বেশির ভাগই ঘুরেফিরে বেতন তুলছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নগর ভবন সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ১৫০ জন দৈনিক হাজিরাভিত্তিক কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দেয়। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এর বিপরীতে মেয়র নিয়োগ দেন ৬৮৭ জনকে। প্রতি মাসে বেতন-ভাতা বাবদ সিটি করপোরেশনের যে ব্যয় হয়, তার অর্ধেকের বেশি যায় হাজিরাভিত্তিক কর্মচারীদের পেছনে। অথচ হাজিরাভিত্তিক এত কর্মচারীর কোনো প্রয়োজন নেই।

সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগরের ২৭টি ওয়ার্ডে সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরসহ ৩৬ জন প্রতিনিধি রয়েছেন। তাঁদের অফিসের জন্য ৭ জন করে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ২৫২ জন কাজ করেন। অন্যরা নগরের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার ও বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করছেন। আগামী মে মাসের পর কাউন্সিলর অফিস থেকে কিছু কর্মচারী কমানো হবে।’
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এখানে বর্তমানে ১০২ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রথম শ্রেণির ৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির ৬ জন, তৃতীয় শ্রেণির ৫৫ জন ও চতুর্থ শ্রেণির ৩২ জন। দৈনিক হাজিরা ভিত্তিতে ৬৮৭ জন কর্মচারী আছেন। তাঁরা দৈনিক ৩০০ টাকা করে মজুরি পান। প্রতি মাসে করপোরেশনের রাজস্ব তহবিল থেকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৫৩ হাজার ৪৩৬ টাকা বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। এর মধ্যে স্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পান ৩৯ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৬ টাকা। মেয়র ও কাউন্সিলররা পান ১৮ লাখ ২৭ হাজার টাকা। হাজিরাভিত্তিক কর্মীরা পান ৬০ লাখ ৪০ হাজার ৯৬০ টাকা। এত বড় অঙ্কের বেতন পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সিটি করপোরেশনকে।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপম বড়ুয়া বলেন, অতিরিক্ত বহু লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এত লোকের প্রয়োজন নেই। মন্ত্রণালয় ১৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অনুমোদন দিয়েছিল। এখন ৬৮৭ জন রয়েছেন।
কুমিল্লা নগর ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থায়ী কর্মচারীদের বাইরে মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সচিব ও প্রশাসনিক দপ্তরে ১৯ জন হাজিরাভিত্তিক কর্মী রয়েছেন। হিসাবরক্ষণ শাখায় চারজন কর্মী রয়েছেন। কর শাখায় রয়েছেন অন্তত আটজন কর্মচারী। তাঁদের নগর ভবনের বারান্দায় বসে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়ে সাতজন করে কর্মী রয়েছেন। নগরের ১০ নম্বর, ২১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দুজনের বেশি পাওয়া যায়নি।
নগর ভবনের প্রথম শ্রেণির অন্তত তিনজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১১ সালের ১০ জুলাই কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হয়। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন মনিরুল। এরপর থেকে তিনি ঢালাওভাবে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক কর্মী নিয়োগ দেন। মেয়র নিচের দিকে লোকবল নিয়োগ দিলেও এখন পর্যন্ত ওপরের পর্যায়সহ বিভিন্ন ধাপে জনবলকাঠামো তৈরি করতে পারেননি। এতে করে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিভিন্ন পদে চলতি দায়িত্ব দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রস্তাবিত জনবলকাঠামো (অর্গানোগ্রাম) অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণিতে ৮৩ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৭৯ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৫৮৬ জন এবং চতুর্থ শ্রেণিতে ৩৭৯ জনসহ মোট ১ হাজার ১২৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা। বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১০২ জন।
মেয়র মনিরুল হক বলেন, ‘জনবলকাঠামো স্থানীয় সরকার বিভাগে বহু আগে জমা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সরকার অর্গানোগ্রাম পাস না করালে আমি কী করব।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, যোগ্য ও প্রয়োজনীয় লোক নিয়োগ না দিয়ে ঢালাওভাবে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া কোনো অবস্থাতেই ঠিক নয়। সিটি করপোরেশনে কোনো নগর পরিকল্পনাবিদ নেই, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, পশু চিকিৎসকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদের লোক নেই। অবিলম্বে অর্গানোগ্রাম পাস করাতে হবে। ব্যয় কমাতে হবে।