২০ লাখ বাংলাদেশির তথ্য বেহাতের শঙ্কা

>
  • ফেসবুক থেকে তথ্য বেহাত
  • বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই।
  • তথ্য বেহাত হয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রতিকারের উপায় কী, তা স্পষ্ট নয়।

বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ২০ লাখ লোকের ব্যক্তিগত তথ্য ঝুঁকির মধ্যে ছিল এবং তাঁদের অনেকেরই তথ্য তাঁদের অজান্তেই বেহাত হয়েছে বলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে। তবে ঠিক কতজনের তথ্য এভাবে অন্য কারও হাতে পড়েছে এবং তার অপব্যবহার হয়েছে, তা জানা যায়নি এবং সম্ভবত কখনোই জানা যাবে না। ফেসবুকের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা, মাইক শ্রোয়েফার গত বুধবার রাতে ফেসবুক নিউজরুমের এক ব্লগে এ কথা জানিয়েছেন।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যেসব পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরা হয় ওই নিবন্ধে। তাতে মাইক শ্রোয়েফার বলেছেন যে এত দিন ফেসবুকে কেউ কাউকে খুঁজে বের করার জন্য তাঁর টেলিফোন নম্বর অথবা ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহার করে তাঁকে খুঁজে বের করতে পারতেন। একাধিক ব্যক্তির একই নাম থাকা অথবা কারও পুরো নাম না জানা থাকায় অনেকেই ফোন নম্বর বা ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহার করতেন। কিন্তু অনেকে অসৎ উদ্দেশ্যে এভাবে অন্যের প্রোফাইল খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন।

মাইক শ্রোয়েফার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে দেশটিতে ফেসবুকে প্রোফাইল খোঁজা বা অনুসন্ধানের ৭ শতাংশই হয়েছে টেলিফোন নম্বর বা ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহারের মাধ্যমে। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ (সূত্র: ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটাস)। সেই হিসাবে ঝুঁকির মুখে থাকা ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ লাখ ৬০ হাজার। সাধারণত, ব্যবহারকারীদের তাঁদের অ্যাকাউন্ট বা পাসওয়ার্ড পুনরুদ্ধারের সময় এই টেলিফোন নম্বর বা ই-মেইল ঠিকানা দিতে হয়েছে এবং তারপর সেগুলো সংরক্ষণে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না বলেই তাঁর ব্যাখ্যায় ধারণা পাওয়া যায়।

ফেসবুকের প্রযুক্তিপ্রধান লিখেছেন, ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যে উন্নত ধরনের তৎপরতা দেখা গেছে, তাতে তাঁদের বিশ্বাস, এই পদ্ধতিতে অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারীর পরিচয় প্রকাশিত হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। সুতরাং, ফেসবুক (গত বুধবার থেকে) এই ব্যবস্থাটি বন্ধ করে দিয়েছে। অ্যাকাউন্ট পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটিও বদলানো হয়েছে, যাতে অন্য কেউ অজান্তে কারও সম্পর্কে এসব তথ্য না পান।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেন, টেলিফোন নম্বর ও ই-মেইল ঠিকানা এবং এ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো যাঁরা গোপন রাখার ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছিলেন, তাঁরা অনেকাংশেই ঝুঁকিমুক্ত ছিলেন।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়ার একাধিক কেলেঙ্কারি বৈশ্বিক গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর দুনিয়াজুড়ে সৃষ্ট বিতর্কের পটভূমিতে ফেসবুক তার তথ্যভান্ডারের নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তার অংশ হিসেবেই কিছু পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বার্তা প্রচারের জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ফেসবুকের প্রায় পাঁচ কোটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করেছে, এমন খবর প্রকাশের পর ফেসবুক গত বুধবার স্বীকার করেছে, এই সংখ্যা ৮ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি। ফেসবুকের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাবিরোধী বিদ্বেষ ছড়ানো ও গণহত্যার উসকানিতে পরোক্ষ সহায়তার অভিযোগও উঠেছে।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতা এবং সংশ্লিষ্ট দেশ বা জোটের আইন লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে তথ্য কমিশনগুলো আলাদা আলাদা তদন্ত শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই। তাই ফেসবুকে বাংলাদেশিদের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হওয়ার কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রতিকারের উপায় কী, তা স্পষ্ট নয়।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিব-উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুক থেকে বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের তথ্য হাতিয়ে নিলে এবং তা ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হলে তাতে বাংলাদেশের কোনো কিছু করার আইনি সুযোগ নেই। সরকারের উচিত এখনই ফেসবুকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার ব্যাপারে ভূমিকা নেওয়া। তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় আইন করার দাবি দীর্ঘদিন ধরে করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো সরকার সেটি করেনি। অথচ আমাদের সংবিধানে ব্যক্তিগত তথ্যের হেফাজত রাখা একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়।’

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা এবং তার অভিভাবক প্রতিষ্ঠান এসসিএলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে নির্বাচন প্রভাবিত করায় ফেসবুকের তথ্যগুলো বেআইনিভাবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে কাজ করার লক্ষ্যে আলোচনা চালাচ্ছে বলেও ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশে কোনো দল, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি।

ফেসবুক বুধবার আরও যেসব পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে আছে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ও স্ট্যাটাসে বিভিন্ন অ্যাপসের অভিগম্যতা (অ্যাকসেস) নিয়ন্ত্রণ। মেসেঞ্জার অথবা অ্যান্ড্রয়েডে ফেসবুক লাইট ব্যবহারকারীদের কল এবং বার্তা আদান-প্রদানের রেকর্ড এক বছরের বেশি সংরক্ষিত থাকবে না।