মাদক কেনাবেচায় নেই রাখঢাক

>
  • মিরপুরের বিহারি ক্যাম্প
  • মাদকের টাকার ভাগ নিয়ে খুন-অশান্তি।
  • স্থানীয় কাউন্সিলর পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
  • মাদক কেনাবেচায় পুলিশের সহায়তা।

পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পের যে জায়গায় রুবেলের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে ছিল, তার পাশেই ছিল রক্তমাখা চাপাতি, গ্যাস লাইটার ও ইয়াবা সেবনের জন্য টাকা দিয়ে মোড়ানো নলটা। মাদকের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ, সে থেকে এই হত্যাকাণ্ড-স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের ধারণা এমনই।

তবে রুবেলই যে এ ধরনের ঘটনার প্রথম শিকার তা নয়, পল্লবীর বিহারি ক্যাম্প এলাকায় ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাদকের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ, চুরি-ছিনতাই ক্যাম্প এলাকার নিত্যদিনের ঘটনা। শুধু যে বিহারিরাই এতে জড়াচ্ছেৎ তা নয়, এর শিকার হচ্ছে আশপাশের এলাকার বাসিন্দারাও। মাদক সেখানে রীতিমতো ‘ব্যবসা’-এ নিয়ে কোনো রাখঢাক নেই। ক্যাম্পের বৃদ্ধ-শিশু সবাই জানে কে কিনছে আর কে বিক্রি করছে। অভিযোগ আছে, স্থানীয় কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম ও পুলিশ মাদক বিক্রেতাদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

রুবেল খুন হন গত ৩১ মার্চ রাতে, ক্যাম্প এলাকায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্মাণাধীন একটি বিপণিবিতানের তৃতীয় তলায়। প্রায় ছয় বিঘা জমির ওপর ২৪ বছর ধরে নির্মাণাধীন এই ভবনের ভেতর দুই হাজার দোকান আছে। তারই একটিতে হত্যাকাণ্ড ঘটে। সোমবারও তৃতীয় তলায় রক্তের দাগ ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিদিন বিকেল থেকে ভোর হওয়া পর্যন্ত এই মার্কেটের ভেতর মাদকসেবীরা আড্ডা বসায়। দিনের বেলায় তাঁরা মার্কেটের ভেতর ঢুকতে ভয় পান। রুবেলকে নিয়ে এই মার্কেটে মাদকের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে তিনজন খুন হয়েছেন। অপর দুজনের একজনের নাম সাইফুল, অন্যজনের নাম জানা যায়নি। এলাকাবাসী তাঁকে নওশা বলে জানেন। বর সেজে বিয়ে করতে আসার পথে তাঁকে তুলে নিয়ে খুন করা হয়েছিল। বিপণিবিতানের ঠিক পেছনে কমিউনিটি পুলিশের কার্যালয়।

রুবেলের মা হালিমা বেগম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যার দিকে তিনি শুনতে পান, তাঁর ছেলে রুবেলকে কারা কুপিয়েছে। তিনি এক দৌড়ে বিপণিবিতানের ভেতরে ঢুকে দেখেন, তাঁর ছেলের নামে নাম আরেক রুবেল (পেশায় কসাই) দৌড়ে পালাচ্ছেন। এই রুবেল গত অক্টোবরে নিহত শিমুলের ভাই। শিমুলের পরিবারের ধারণা, তাঁকে খুন করেছেন কসাই রুবেল, তাঁর ভাই মোস্তফা ও মামা বাবর। ক্ষতি হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে তিনি পল্লবী থানায় একটি জিডিও করে রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিপণিবিতানের মাদকের আড্ডাটা চালান রুবেলের মামা বাবর (হিজড়া)। রুবেল মাদক কেনাবেচা করতেন, শিমুলও তাই। বাবরের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও থানার ভালো যোগাযোগ আছে। অবশ্য বাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা তাঁর ভাগনেকে খুন করেছে তারা ট্যাবলেট-টুবলেট খায়, লোক ভাড়া করে খুনখারাবি করায়।’

এই এলাকায় কারা মাদক ব্যবসা করে সে সম্পর্কে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে দুটি সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এডিসি ক্যাম্প, মিল্লাত ক্যাম্প, রহমত ক্যাম্প, মুসলিম ক্যাম্প, থার্টিনাস ক্যাম্প, কুর্মিটোলা ক্যাম্প এলাকায় মাদকের বেচাকেনা হয়। তবে খুব বড় কোনো চালান কখন ধরা পড়েনি। মূলত মোহাম্মদপুর, আবদুল্লাহপুর ও টঙ্গী থেকে মাদক এনে পল্লবীতে বিক্রি করা হয়। থানায় বিভিন্ন অপরাধে যত মামলা হয়, তার প্রায় অর্ধেকই এসব ক্যাম্প এলাকায় মাদক কেনাবেচার অপরাধ।

স্থানীয় বাসিন্দারা বেশ কয়েকজন মাদক বিক্রেতার নাম বলেছেন। তাঁরা জানান, আগে ব্যবসাটা করতেন রাজীব নামের এক ব্যক্তি। রাজীব স্থানীয় কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ লোক বলে জানা গেছে। রাজীব গ্রেপ্তারের পর মাদক কেনাবেচার দায়িত্ব পান ইমতিয়াজ। গত ২৮ মার্চ স্থানীয় কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক এলাকায় একটি মাদকবিরোধী সভার আয়োজন করেন। ওই সভায় কাউন্সিলরের সঙ্গে ছিলেন ইমতিয়াজের বাবা। ওই সভায় স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্লা, পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ আছে, কখনো কখনো ইয়াবা বেচাকেনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করলে তাকে ছাড়িয়ে আনতে কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম তদবির করে থাকেন।

জানতে চাইলে কাউন্সিলর জহিরুল প্রথম আলোকে বলেন, ওই সমাবেশে মঞ্চে বা সামনে মাদকসেবী থাকতে পারে। কিন্তু কোনো বিক্রেতা ছিল না। তাঁর সঙ্গে কোনো মাদক ব্যবসায়ীর সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেন জহির।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পল্লবী থানার কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেও মাদক কেনাবেচায় জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। এর মধ্যে ওসি দাদন ফকির ও এসআই এস এম কাওসার সুলতানের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তদন্ত চলছে। পল্লবীতে মাদক ব্যবসায়ী শাহজাদা ও তাঁর স্ত্রী মোসাম্মৎ চান্দার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৫ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করলেও তিনি ৭৫ পিস জব্দ দেখান। এ ঘটনায় মোহাম্মদ ফেরদৌস ও মোসাম্মৎ চান্দাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিন্তু শাহজাদাকে পুলিশ আসামি করেনি। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে খবর ছাপা হওয়ার পর মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত ১ এপ্রিল এই দুজনকে সশরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।

জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দাদন ফকির প্রথম আলোকে বলেন, যেদিন ওই অভিযানটি হয়েছে, সেদিন তিনি ‘স্টেশনে’ ছিলেন না। তিনি বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পের আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে বিহারি ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা চলে আসছে। দেখা যায়, বিভিন্ন সময় অভিযান হয়, কিন্তু ব্যবসা আর বন্ধ হয় না। অভিযান হলে কিছুদিন বন্ধ থাকে, তারপর সেই একই দশা।