টাকা খরচ, ডিজিটাল সনদের খবর নেই

  • টাকা নিয়ে গেলেও কাজ বুঝিয়ে দেয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
  • তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী–সচিবের নির্দেশে টাকা দেওয়া হয়েছিল।
  • টাকা উদ্ধারে বর্তমান সরকারেরও কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল সনদ তৈরির নামে সরকারের এক কোটি টাকা মেরে দিয়েছে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসংবলিত এসব সনদ তৈরি করে দেওয়ার কথা বলে কোনো কাজ না করেই অগ্রিম টাকার বেশির ভাগ তুলে নিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের নির্দেশে এ টাকা দেওয়া হয়েছিল।

টাকা উদ্ধারে বর্তমান সরকারেরও কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ফলে ডিজিটাল সনদ তৈরির জন্য দেওয়া টাকা জলে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এমনকি মন্ত্রণালয়ের বর্তমান মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, প্রতিষ্ঠানটি কাজ বুঝিয়ে না দিয়ে টাকা নিয়ে গেছে। তবে এ দায় তিনি তাঁর আগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলে উল্লেখ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর উপস্থাপন করা শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকায় জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেডের নাম আছে। প্রতিষ্ঠানটি ছয়-সাত বছর ধরেই খেলাপির তালিকায় আছে। এসব জানার পরও ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ডাটাবেজ তৈরি ও গণউদ্বুদ্ধকরণ’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় ডিজিটাল সনদ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এ কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ১ কোটি ৮২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪০ টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়। প্রকল্পের জন্য ১০ শতাংশ অগ্রিম দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এ নিয়ম ভেঙে প্রতিষ্ঠানকে ৫০ শতাংশের বেশি ১ কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ডিজিটাল সনদ বুঝিয়ে দেয়নি।

গত প্রায় এক সপ্তাহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাব, প্রকল্প ও প্রশাসনিক শাখা ঘুরে কর্মকর্তাদের কাছে এ প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৪ সালের পর এ বিষয় নিয়ে আর কোনো বৈঠক বা সিদ্ধান্ত হয়নি। গত কয়েক দফায় কর্মকর্তা বদল হওয়ার এ-সংক্রান্ত নথি কেউ ছুঁয়েও দেখেননি বলে জানান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, প্রতিষ্ঠানটি মন্ত্রণালয়ের এক কোটি টাকা নিয়ে গেছে জানতে পেরে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিষয়টি অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। দুদক এ-সংক্রান্ত নথিপত্রও নিয়েছিল। পরে বিষয়টি আর এগোয়নি। তিনি বলেন, ‘এ দায় আমাদের নয়, আগে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে শুধু কাজই দেননি, অগ্রিম টাকাও দিয়েছেন।’

২০১৪ সালের ৫ মে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে দুজন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল। একটি হলো জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেড, আরেকটি স্যাফরন করপোরেশন লিমিটেড। এই প্রকল্পের তৎকালীন কর্মসূচি পরিচালক সৈয়দ মুজিবুল হক সভাকে জানান, তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এবং সচিব মিজানুর রহমানের নির্দেশে এ প্রতিষ্ঠানকে অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে নথিপত্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখা থেকে সম্পাদিত হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ওই সভায় নির্দেশ দেওয়া হয়। সাবেক কর্মসূচি পরিচালক কোনো অগ্রিম অর্থ দেওয়া হয়েছে কি না, দেওয়া হলে তা কোন বিধিতে দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দেবেন বলেও জানান। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলার জন্য এই প্রকল্প যেমন আলোর মুখ দেখেনি, তেমনি মন্ত্রণালয় টাকাও ফেরত পায়নি।

তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গতকাল প্রথম আলোকে জানান, ‘এটা তো আমি এখন বলতে পারব না। এটা চলমান প্রক্রিয়া। সনদ তো তৈরি হয়ে রয়েছে। এখন কী করছে না করছে জানি না। বর্তমান সচিব এ বিষয়ে বলতে পারবেন।’ একই বিষয়ে সচিব মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অগ্রিম নেওয়ার বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই।

স্যাফরন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্মল গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা না থাকার কারণে প্রকল্পটি ভেস্তে গেছে। তবে তাঁরা কোনো টাকাপয়সা নেননি। যা নিয়েছে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেড।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ইস্যুকৃত সনদ বিভিন্ন সময়ে জাল হওয়ায় যাচাই-বাছাই করতে অসুবিধা হচ্ছিল। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তার চিহ্ন এবং বারকোড-সংবলিত সনদ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এ সনদ ছাপানোর কথা ছিল সরকারি সিকিউরিটি প্রেস থেকে। তা না করে ঋণখেলাপি জানার পরও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেপাল চন্দ্র ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, এ প্রকল্পের জন্য যারা অগ্রিম টাকা নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এ প্রতিষ্ঠানে নেই। এ ছাড়া সরকার বদল হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ে নানা ধরনের ইস্যুতে সরগরম থাকায় বিষয়টি নিয়ে তাঁরা আর কথা বলেননি। চুক্তি অনুযায়ী তাঁরা অনেক কাজ করেছেন। সনদও বানিয়েছিল, যা তাঁদের গোডাউনে পড়ে আছে। এ ছাড়া তাঁরা কিছু কম্পিউটার সরবরাহ করেছিলেন, যা পরে পাওয়া যায়নি। তবে এটা সঠিক, তাঁরা টাকাটা ফেরত দেননি।