বনের গাছ কাটতে চায় বন মন্ত্রণালয়

তেলের ডিপো করার জন্য কাটা পড়বে কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের সোনারপাড়ার সংরক্ষিত এই বন।  ছবি: প্রথম আলো
তেলের ডিপো করার জন্য কাটা পড়বে কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের সোনারপাড়ার সংরক্ষিত এই বন। ছবি: প্রথম আলো
>
  • উজাড় হবে মহেশখালীর বন
  • ১৯২ একর বনভূমি ব্যবহারের অনুমোদন।
  • প্রতিবছর মাত্র ৪৫ লাখ টাকা রাজস্ব।
  • কাটা পড়বে ১ হাজার ৭০১টি প্রাচীন গাছ।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও বন বিভাগের আপত্তি উপেক্ষা করে কক্সবাজারের মহেশখালীর পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ১৯২ একর সংরক্ষিত বনভূমিতে জ্বালানি তেলের ডিপো নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এ জন্য দেশের একমাত্র পাহাড়ি এই দ্বীপ বনটির কয়েক হাজার গাছ কাটতে হবে এবার। তারই অনুমোদন নিতে গত ২৭ মার্চ বিষয়টি মন্ত্রিসভায় পাঠিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।

প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি গত ১ মার্চ অনুমোদন দেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে ওই এলাকার প্রকৃতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। মহেশখালীর বন ও বন্য প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি হবে। ডিপো থেকে রাসায়নিক বর্জ্য দ্বীপ ও সাগরে ছড়িয়ে পড়বে। পানি দূষিত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া জাহাজ আসা-যাওয়া এবং তেলের টার্মিনালের যান্ত্রিক তৎপরতার কারণে শব্দদূষণ হবে।

২০১৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘সংরক্ষিত বনে তেলের ডিপো!’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে বনের ১৯২ একর জমি ইজারা চাওয়া হয়েছিল। দুই বছর পর সেই জমিতে তেলের ডিপো নির্মাণের অনুমতি দিল সরকার। এবার সেখানে স্থাপনা নির্মাণের জন্য গাছ কাটতে চাইছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।

গাছ কাটার পক্ষে মতামত দিতে ইতিমধ্যে মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে বন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, বিপিসির এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে ১ হাজার ৭০১টি প্রাচীন গাছ এবং ১ হাজার ২৫০টি বল্লি, ঝাড় ও জ্বালানি গাছ কাটা পড়বে। এসব বনজ সম্পদের ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।
এদিকে সংরক্ষিত এই বনভূমি ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে বন বিভাগেরও আপত্তি ছিল। গত বছরের শুরুতে আপত্তি তুলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছিল, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রায় ২৫ হাজার গাছ কাটা পড়বে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নয়ন চাইলে এ ধরনের প্রকল্পের অনুমতি দিতে হবে। তবে আমরা চেষ্টা করব যাতে বেশি ক্ষতি না হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের শর্ত দিয়েছি, যে পরিমাণ গাছের ক্ষতি হবে, তার পাঁচ গুণ গাছ লাগাতে হবে। এ ছাড়া বিপিসিকে ১০ বছর গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করতেও বলেছি।’ এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে বলে জানান সচিব।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় তেলের ডিপো নির্মাণ করা হবে। বিদেশ থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে মহেশখালীর ডিপোতে আনা হবে। সেখান থেকে চট্টগ্রামের অপরিশোধিত তেল আনোয়ারায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে নেওয়া হবে। ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ শীর্ষক এই প্রকল্পে চীনের এক্সিম ব্যাংক অর্থায়ন করছে।

সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ২০১৫ সালের দিকে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবটি পাঠিয়ে বনভূমি ব্যবহারের অনুমতি চায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বন অধিদপ্তর থেকে পাঁচ×সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি বনজ সম্পদের ক্ষতিপূরণের জন্য ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪৪ কোটি ৯৮ লাখসহ মোট ৪৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা পরিশোধ করতে প্রকল্প পরিচালককে অনুরোধ জানায়। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয় জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে জীববৈচিত্র্যের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে বন বিভাগ, বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল বিভাগের ছয়জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি স্বতন্ত্র গবেষণার মাধ্যমে বনের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করে।

জীববৈচিত্র্যের মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সুপারিশ করেছিলেন বনভূমি ব্যবহারের অনুমতি না দিতে। আর দিতেই যদি হয়, তবে ২৭৭ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে। এখন ক্ষতিপূরণ না দিয়ে ইজারা বাবদ নামমাত্র মূল্যে এই বন দিয়ে দেওয়া হলো। এই বনভূমি আর কখনো ফেরত পাওয়া যাবে না।

প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি চিঠি চালাচালি এবং তাতে স্বাক্ষর দিয়ে অনুমোদন দিলেই শত বছর ধরে গড়ে ওঠা একটি বন ও পাহাড় ধ্বংস করা যায়। তাই বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত বনগুলো সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।