গাজীপুরে ভোট স্থগিতের পেছনে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আ.লীগের কোন্দল

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

গাজীপুরে রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আলোচনার মূল বিষয় এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেন স্থগিত হলো আর কেনইবা সেই স্থগিতাদেশকে স্থগিত করা হলো। স্থানীয় বিভিন্ন পেশার মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিল হয়তো দলীয় প্রার্থী হেরে যাবেন এমন ভয় থেকে সরকার এখন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে চাইছে না। এ কারণে রিট করে আটকে দিয়েছে। আলোচনায় উদাহরণ টেনেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিতের ঘটনাকে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার পর গাজীপুরবাসীর সন্দেহের তির এখন সরকারের ওপর থেকে কিছুটা সরে গিয়ে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ওপর পড়েছে।

নানা মহলের আলোচনায় এখন উঠে আসছে গাজীপুরে সরকারি দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে সেখানকার রাজনীতিবিদ ও রাজনীতি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন এমন ব্যক্তিরা বলেন, নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় পেছনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কোন্দলই প্রধান কারণ। তবে এমন মতও আছে, নির্বাচন পিছিয়ে নেওয়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মাঠের অবস্থা ভালো হবে। এতে সরকারই লাভবান হবে। তাঁরা বলছেন, সিটি নির্বাচন নিয়ে যা হলো, তাকে কেবল স্থানীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নয় বরং আওয়ামী লীগের জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক কৌশল।

১৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু হাইকোর্টের আদেশে প্রথমে ভোট আটকে যাওয়া এবং পরে আপিল বিভাগ সেটি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আবার ভোট উৎসব শুরু হয়েছে গাজীপুরে। তবে এখনো ভোটের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ হয়নি। রোজার ঈদের পর এই ভোট হতে পারে। বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে নানা আলোচনা থাকলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা শেষ মুহূর্তে ভোট বন্ধে একে অন্যকে দোষারোপ করছেন। ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হলেও কারা এর পেছনে, সে ব্যাপারে দলটি কিছু বলতে চাইছে না। অন্যদিকে বিএনপি সরাসরি বলেছে, জিততে পারবে না জেনে সরকার আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এমন কাজ করছে।

যাঁর রিটের কারণে এই নির্বাচন বন্ধ হয়েছে, সেই শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ বি এম আজহারুল ইসলাম আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি আরও বেশি সামনে এসেছে।

গাজীপুর চৌরাস্তা মোড়ে কথা হয় ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরে। তিনি ৩৬ বছর ধরে হাজীপুরে পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে ২৭ জন সদস্য। আগে তাঁরা চাঁদপুরের ভোটার ছিলেন। এখন গাজীপুরের ভোটার করেছি।’ তিনি আরও বলেন, হঠাৎ ভোট বন্ধ করে দেওয়া হলো। তখন মনে হয়েছিল নিশ্চই সরকারের কেউ পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে। না হলে এটি বন্ধ হলো কেন? আবার আদালতের রায়ে যখন এটি তুলে দেওয়া হলো, তখন মনে হলো এটি কি তাহলে গাজীপুরের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পক্ষের মধ্য বিরোধের কারণে হয়েছে?
বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আজমত উল্লাহ একজন যোগ্য রাজনীতিবিদ। তাঁকে বাদ দিয়ে জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগের সমর্থন দেওয়ার পর তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা প্রকাশ্য এর বিরোধিতা না করলেও এতে তাঁদের মন খারাপ হওয়ার কথা। আমি মনে করি এর প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। সে জন্য এলাকা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যার কারণে প্রথমে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। এলাকা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যা থাকলে সেটা এত দিন চোখে পড়েনি? নির্বাচনের অল্প কিছুদিন আগেই এটি চোখে পড়ল কেন? কেন আগে এ বিষয়টি সামনে এল না?’

গাজীপুরের স্থানীয় বাসিন্দা মো. নূর বক্স মিয়ার বিশ্বাস, এখানে আওয়ামী লীগের কোন্দোলের কারণে নির্বাচন হবে কি হবে না, তা নিয়ে সংশয় দেখা গিয়েছিল। গাজীপুর সদরে যাওয়ার পথে চৌরাস্তায় পান-সুপারির দোকানদার মো. আলী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের লোকজনদের মধ্যে গন্ডগোল আছে। তয় কেন নির্বাচন বন্ধ হইছিল, তা বলতে পারব না।’

মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রবীণ নেতা আজমত উল্লাহ খান। তিনি এখন জাহাঙ্গীর আলমের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আজমত উল্লাহ মেয়র পদে নির্বাচন করেন। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, আজমত আওয়ামী লীগের পুরোনো নেতা। এলাকায় ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এবার তিনি মনোনয়ন পাননি। তা ছাড়া আগামী নির্বাচনে সংসদ নির্বাচনে তাঁর এলাকা টঙ্গীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ হাসানই প্রার্থী হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে আজমত উল্লাহর পক্ষের অনেকেই চাইবেন না গাজীপুরে তাঁদের নেতার রাজনীতি কোণঠাসা হয়ে পড়ুক। এ কারণে ওই পক্ষের কেউ আদালতে রিট করে থাকতে পারেন। তা ছাড়া দুই নেতার পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও। তাঁদের মদদও থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অবশ্য আজমত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দলের মধ্যে কোনো কোন্দল বা ঐক্যের সমস্যা নেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ঐক্যের সমস্যা নেই। দলের প্রয়োজনে আমি যেকোনো কাজ করতে রাজি আছি।’

একই কথা বললেন জাহাঙ্গীর আলমও। তাঁর মতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিব্রত করতে এমনটা করা হয়েছে। সরকার বা আওয়ামী লীগ এটা করেনি। এর পেছনে যুক্তি হলো আওয়ামী লীগের সব পর্যায় থেকে চাওয়া হয়েছে যেন নির্বাচন হয়। নির্বাচন ঘিরে একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে জানান এই নেতা। তিনি বলেন, এটা কেটে গেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা পারেনি।

নির্বাচন বন্ধ হওয়ার পর আবার তা করার ব্যাপারে আদালতের আদেশ নিয়ে আর কিছু ভাবতে চান না বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আপিল করেছি। রায় পেয়েছি। এতে সন্তুষ্ট। এখন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, এটাই আশা করি।’ তিনি আরও বলেন, বিএনপি চেয়েছেন ভোট হোক। ভোটের মাঠে তাঁর অবস্থা ভালো।

বিএনপির নেতাদের তির যখন আওয়ামী লীগের দিকে ছিল, তখন অবশ্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তাঁদের প্রার্থীর অবস্থা ভালো। তাঁরা কেন নির্বাচন না হোক সেটা চাইবেন?