জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এল ভয়ংকর তথ্য

>
  • হাতিয়ায় দুই বছর আগে গণপিটুনিতে নিহত হন চার যুবক
  • ডাকাত সন্দেহে স্থানীয় লোকজন তাঁদের পিটিয়ে হত্যা করে
  • পাঁচ মাস আগে নব্য জেএমবির এক সংগঠক গ্রেপ্তার হন
  • সংগঠককে জিজ্ঞাসাবাদে ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে আসে
  • হাতিয়ায় নিহত চারজনই ছিলেন নব্য জেএমবির সদস্য
  • নব্য জেএমবি হাতিয়ার চরে ঘাঁটি করতে চেয়েছিল

নোয়াখালীর হাতিয়ায় দুই বছর আগে গণপিটুনিতে নিহত হওয়া চার যুবক ডাকাত ছিলেন না। ২০১৬ সালের ১১ মার্চ রাতে ডাকাত সন্দেহে স্থানীয় লোকজন তাঁদের পিটিয়ে হত্যা করে। থানার পুলিশও তদন্ত করে এটিকে নিছক ডাকাতির ঘটনা বলে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু পাঁচ মাস আগে নব্য জেএমবির অন্যতম এক সংগঠককে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে আসে। ওই জঙ্গি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করেছেন, হাতিয়ায় নিহত চারজনই ছিলেন নব্য জেএমবির সদস্য। তাঁদের মধ্যে নৌপ্রকৌশলী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও ছিলেন। হাতিয়ায় ঘাঁটি গড়ার পরিকল্পনা ছিল নব্য জেএমবির।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে নব্য জেএমবির সংগঠক আবদুস সামাদ ওরফে মামুকে গ্রেপ্তার করেন তাঁরা। জিজ্ঞাসাবাদে দেশে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন তিনি। জঙ্গি ‘মামু’ বলেছেন, উপকূলীয় এলাকায় ঘাঁটি গড়ার পরিকল্পনা ছিল তামিম চৌধুরীর (বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক এবং গুলশান হামলার সমন্বয়ক, ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে জঙ্গি আস্তানায় নিহত হন)। ঘাঁটি গড়ার জন্য জায়গা দেখতে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আবু বকর, আউয়ালসহ অন্যরা হাতিয়ায় যান। সেখানে এক রাতে তাঁরা জনতার হাতে নিহত হন। এরপর ঘাঁটি গড়ার পরিকল্পনা থেকে সরে আসেন তামিম।

জঙ্গি ‘মামু’ যে আউয়ালের কথা বলেছেন, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্যের শিক্ষার্থী আবদুল আউয়াল বলে অনেকটাই নিশ্চিত কাউন্টার টেরররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় তিনি নিখোঁজ হন। এ নিয়ে তিন বছর আগে পরিবার থানায় জিডি করেছিল।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, কানাডা থেকে তামিম চৌধুরী বাংলাদেশে এসে প্রথম যে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আউয়াল। ২০১৩ সালের অক্টোবরে দেশে এসে তামিম বেশ কিছুদিন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছিলেন। রাজশাহীর একটি মেসেও ছিলেন। সেখানে আউয়াল, মামুসহ (সামাদ) আরও দু-তিনজন ছিল।

আউয়ালের বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুরের ঘোষপাড়ায়। ছেলের ফেরার প্রতীক্ষায় রয়েছেন বাবা নুরুল ইসলাম ও মা আলেয়া ইসলাম। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি আউয়ালদের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর বাবার সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের ১১ জুন রাজশাহী থেকে নিখোঁজ হন আউয়াল। ছেলে মারা গেছেন, এমন তথ্য পুলিশের কেউ তাঁকে জানায়নি। নুরুল ইসলাম সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার আহমেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ধারণা করেন, নওগাঁর আবদুল আউয়াল হাতিয়ায় নিহত হয়েছেন। সেখানে ধরা পড়ার পর জঙ্গিরা প্রথমে পুলিশকে যে নাম-ঠিকানা দিয়েছিলেন, তা পুরোপুরি সত্য ছিল না।

হাতিয়ায় গণপিটুনির ঘটনা
পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১১ মার্চ সন্ধ্যায় হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাটে ভেড়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। নৌকায় ১০-১২ জন যুবক ছিলেন। ঘাটের লোকজন পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা প্রথমে নিজেদের কোস্টগার্ডের সদস্য, পরে জেলে হিসেবে পরিচয় দেন। এতে ঘাটের লোকজনের সন্দেহ হয়। এর মধ্যে দুই যুবক একটি পাটের বস্তা নিয়ে নৌকা থেকে ঘাটে ওঠেন। লোকজন বস্তা তল্লাশি করে কয়েকটি ধারালো অস্ত্র দেখতে পান। পরে লোকজন নৌকাটি ঘেরাও করে চেয়ারম্যান ঘাট পুলিশফাঁড়িতে খবর দেয়।

পুলিশ এসে প্রথমে পাঁচজন, পরে আরও এক যুবককে আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে বেঁধে রাখে। সেদিন রাত পৌনে ১১টার দিকে ফাঁড়িতে জেনারেটরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকার নেমে আসার পরপরই আটক যুবকেরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে তিন পুলিশ সদস্যকে আহত করে পালানোর চেষ্টা করেন। পুলিশের চিৎকারে লোকজন ছুটে এসে ধাওয়া দিয়ে যুবকদের গণপিটুনি দেন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে চারজনের মৃত্যু হয়। নোয়াখালী পুলিশের তথ্য অনুযায়ী নিহত ব্যক্তিরা হলেন আবু বকর ছিদ্দিক (২৭), সাইফুল ইসলাম (২২), আকবর আলী (২৪) ও অজ্ঞাতপরিচয় যুবক। গণপিটুনিতে আহত হন আরও দুজন। অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে নোয়াখালীতে দাফন করা হয়।

নোয়াখালীর তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পিবিআই) নব্যজ্যোতি খীসা প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময় ডাকাতির চেষ্টা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়। একটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে র‍্যাব গাজীপুরে একটি অভিযান চালিয়ে নৌ প্রকৌশলী আবু বকরের জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে তথ্য পায়, যিনি হাতিয়ায় নিহত হন।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ওমর ফারুক, নওগাঁ ও মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালী)